উত্তরাঞ্চলে রেকর্ড চা উৎপাদনের সম্ভাবনা
এগ্রিবিজনেস
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চা উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। স্থানীয়দের মধ্যে চা চাষে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ ও চলতি মৌসুমে অনুকূল আবহাওয়ার কারণে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে৷
পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট–উত্তরাঞ্চলের এই ৫ জেলায় চা উৎপাদন ইতোমধ্যেই বছরে ৩১ শতাংশ বেড়েছে। গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। গত বছর এই অঞ্চলে চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৩ মিলিয়ন কেজি।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য মতে, এই বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে উৎপাদিত ৮৯ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন কেজি উৎপাদিত চায়ের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের মোট উৎপাদন ছিল ১৫ শতাংশ।
বিটিবির তথ্য অনুসারে, দেশে বার্ষিক চায়ের ব্যবহার ২০১৯ সালে ছিল ৯৫ মিলিয়ন কেজি, ২০০৭ সালে যা ছিল ৪৬ মিলিয়ন কেজি।
যেহেতু চলতি ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত উৎপাদন অব্যাহত থাকবে, চা-বাগান মালিক ও বিটিবি কর্মকর্তারা আশা করছেন যে এই বছর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মোট চা উৎপাদন ১৪ মিলিয়ন কেজি ছাড়িয়ে যাবে।
চা চাষি ও কারখানার মালিকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে সরকার সীমান্তবর্তী পঞ্চগড় জেলায় চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। গত মাসে মন্ত্রিসভা বিটিবিকে উত্তরাঞ্চলে চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপন করতে নিরীক্ষা করার নির্দেশনা দিয়েছে।
ইতোমধ্যে পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে চা শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা গত সপ্তাহে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে রংপুরে আরও একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন বিটিবির আঞ্চলিক কার্যালয়, পঞ্চগড়ের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামীম আল মামুন।
চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সভায় পঞ্চগড়ে চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, পঞ্চগড়ের কারখানাগুলোয় উৎপাদিত চা চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গল চা নিলাম কেন্দ্রে বিক্রি করা হয়।
দূরত্বের কারণে পরিবহণে চায়ের গুণগত মান হ্রাস পাওয়ায় পঞ্চগড়ের চা একদিকে নিলামে কম দামে বিক্রি হচ্ছে, অপরদিকে উত্তরাঞ্চলের চা কারখানাগুলোকে তুলনামূলক বাড়তি পরিবহন খরচ বহন করতে হচ্ছে।
এসব সমস্যার কারণে ওই অঞ্চলের চা শিল্পে উত্তরোত্তর সফলতা ও অপার সম্ভাবনা প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। এ কারণে উত্তরবঙ্গে চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
তিনি পঞ্চগড়ে চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে চা বোর্ডের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার পাশাপাশি টিটিএবি, টিপিটিএবি ও ব্রোকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
‘পঞ্চগড়ে নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চা চাষিরা উপকৃত হবেন। এটি উত্তরাঞ্চলে চা শিল্পের বিকাশে সহায়তা করবে এবং আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে,’ বলেন অঞ্চলের স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিরুল হক খোকন।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার চা চাষি ইসহাক আলী মন্ডল জানান, চা চাষিরা প্রতি কেজি সবুজ চা পাতার জন্য ১৬ থেকে ২৫ টাকা পান। এখানে নিলাম কেন্দ্র স্থাপিত হলে আরও ভালো দাম পাওয়া যাবে যাতে করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিরা উপকৃত হবেন এবং চা চাষে আগ্রহ বাড়বে।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার পেডিয়াগাছ গ্রামের চা উৎপাদনকারী আবুল হোসেন বলেন, নিজের জমিতে চা চাষ করা ক্ষুদ্র চাষিরা এখন সচ্ছল হয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, ‘চা চাষ শুরু করার আগে আমার জমি অব্যবহৃত ছিল।’
বিটিবি কর্মকর্তার মতে, বর্তমানে এই অঞ্চলে চা চাষের উপযোগী প্রায় ৫০ হাজার একর জমির মধ্যে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও নীলফামারীতে ১০ হাজার ১৭০ একর জমিতে চা চাষ হয়।
এ বছর প্রায় ২ হাজার একর জমি চা চাষের আওতায় এসেছে, এতে করে চা চাষের পরিধি ১২ হাজার একর ছাড়িয়ে যাবে।
বিটিবির তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে চা চাষ বার্ষিক গড়ে ১৫ শতাংশ হারে বেড়েছে।
এই অঞ্চলে ২৬টি বড় বাগান ছাড়াও ৭ হাজার ৩১০ জন ক্ষুদ্র চাষি রয়েছেন।
করতোয়া চা বাগান ও কারখানার মালিক এএস শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, এই অঞ্চলে চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপন করা হলে পরিবহন খরচ কমবে। এতে করে চাষি ও কারখানা মালিক উভয়ই উপকৃত হবেন।
১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অঞ্চলে সফরের পর তার নির্দেশনা অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন পরীক্ষামূলক চা চাষ করে।
পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষে সফলতা দেখা দিলে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চা চাষ সম্প্রসারিত হতে শুরু করে।
চা চাষের ফলে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে প্রায় ২৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যাদের একটি অংশ নারী।
উত্তরাঞ্চল এখন দেশের তৃতীয় বৃহত্তম চা উৎপাদনকারী অঞ্চল।