ছোট কানাকুক্কা
প্রাণ ও প্রকৃতি
ড. আ ন ম আমিনুর রহমান।। বালি হাঁসের প্রজনন-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলে গেলাম ২০১২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। সারাটা দিন বিলে ঘুরে ঘর্মক্লান্ত দেহে পড়ন্ত বিকেলে বিলের পাশের পুকুর ও খালের মাঝের রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম। কিছুটা দূরে সিএনজি অটোরিকশা দাঁড়িয়ে আছে আমাদের নিয়ে মৌলভীবাজার যাবে বলে।
সহকর্মী ড. জীবন চন্দ্র দাস, ড. সদরুল ইসলাম ও প্রয়াত বন্যপ্রাণীপ্রেমী তানিয়া খানের সঙ্গে গল্প করতে করতে এগোচ্ছি। হঠাৎই খালপাড়ের ঢোল কলমির ঝোপ থেকে খয়েরি-কালো কিছু একটা উড়ল। আলো বেশ কমে গেছে। তবুও এক টিপে কয়েকটা ক্লিক করলাম। পাখিটি আবার ঝোপের গভীরে হারিয়ে গেল। আর বের হলো না। কাজেই প্রথমবার দেখা পাখিটির সাক্ষী ছবি নিয়েই খুশি থাকতে হলো।
২০১৯ সালের ৬ নভেম্বর কক্সবাজারের ইনানিতে অবস্থিত বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে একই প্রজাতির একটি পাখিকে উড়ে যেতে দেখলাম। কিন্তু এবারও ছবি তুলতে পারলাম না। ২০২০ সালের ৬ নভেম্বর পড়ন্ত বিকেলে ওকে আবার দেখলাম রাজশাহীর পদ্মা নদীর চর মাজারদিয়ারে। কিন্তু ফলাফল একই; আবারও ছবি তুলতে ব্যর্থ হলাম। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির বিকেলে অবশেষে পাখিটির কিছু ভালো ছবি তুলতে সক্ষম হলাম শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলের সেই একই জায়গা থেকে, যেখানে প্রথমবার পাখিটিকে দেখেছিলাম দীর্ঘ সাড়ে আট বছর আগে। এটি ২০১২ সালের সেই পাখিটিরই বংশধর হবে হয়তো। মনটা খুশিতে ভরে উঠল।
এতক্ষণ যে পাখিটির গল্প বললাম, সে এদেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখি ছোট কানাকুক্কা। ছোট কুকো, কুক্কা বা ছোট কুবো (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Bengal Coucal বা Lesser Coucal। বৈজ্ঞানিক নাম Centropus bengalensis। পাকিস্তান ও মালদ্বীপ বাদে ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ চীন, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশে পাখিটির দেখা মেলে।
ছোট কানাকুক্কা বড় কানাকুক্কার খুদে সংস্করণ। দৈর্ঘ্যে পুরুষ ও স্ত্রী যথাক্রমে ৩১ ও ৩৪ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ওজন ৮০-৯২ গ্রাম। প্রজননকালে খয়েরি ডানা বাদে পুরো দেহ চকচকে কালো পালকে মোড়ানো থাকে। তবে ডানা ও কাঁধে প্রায়ই হলুদ ডোরা দেখা যায়। চোখের রং গাঢ় বাদামি। চঞ্চু খাটো ও হলদে। পা, আঙুল ও নখ কালচে। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। প্রজননহীন পাখির কালো পালক হলদে-বাদামিতে রূপান্তরিত হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে প্রজননহীন বয়স্ক পাখির মতোই; তবে ডানা-লেজের ডোরা ছাড়াও দেহের উপরিভাগে কালো ছিটের উপস্থিতি চোখে পড়ে।
ছোট কানাকুক্কা মিশ্র চিরসবুজ বা পত্রঝরা বন, বনের চারপাশ, জলার পাশের ঝোপজঙ্গল ও ঘাসবনের বাসিন্দা। দিবাচর পাখিগুলো সচরাচর একাকী বা জোড়ায় থাকে। অল্প উঁচুতে দুর্বলভাবে উড়ে। ঘাসফড়িং, বড় কীটপতঙ্গ ও ছোট সরীসৃপ এদের প্রধান খাদ্য। সচরাচর ‘পুপ-পুপ-পুপ-টোটক-টোটক…’ শব্দে ডাকে।
মার্চ থেকে অক্টোবর প্রজননকাল। এ সময় ভূমির কাছাকাছি ঘন ঝোপে লতাপাতা ও শিকড় দিয়ে গোলাকার বাসা বানায়; যার একপাশে থাকে প্রবেশপথ। স্ত্রী সাদা রঙের ২-৪টি ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ১৪-১৯ দিনে। স্ত্রী-পুরুষ পালাক্রমে ডিমে তা দেয় ও ছানাদের যত্ন করে। এদের আয়ুস্কাল প্রায় চার বছর।সূত্র: সমকাল
লেখক :অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর