ফিরছে ইলিশের হারানো মৌসুম
মৎস্য
নির্বিঘ্ন প্রজনন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের কারণে গত কয়েক বছরে দেশে ইলিশের শানশওকত বেড়েছে। ওজনে-আকৃতিতে যেমন পুষ্ট হয়েছে, তেমনি উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণ। ফলে বর্ষা মৌসুমকেন্দ্রিক ইলিশ এখন বছরজুড়েই কমবেশি পাওয়া যাচ্ছে। তার সঙ্গে জাতীয় মাছের আরেক বর্ধিত মৌসুম যোগ হয়েছে শীতে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ইলিশের এ সাফল্যের ধারাবাহিকতা ম্লান হয়ে যেতে পারে নির্বিচার জাটকা নিধনের কারণে।
বিশেষজ্ঞদের এ আশঙ্কার সত্যতা মিলেছে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলো ঘুরে। গত বুধ বৃহস্পতিবার বরিশাল নগরের কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, এসব বাজার রুপালি ইলিশে ঠাসা। বড় ইলিশের পাশাপাশি ঝাঁপিতে সাজানো অসংখ্য জাটকাও চোখে পড়ল।
কয়েক বছর ধরে শীতে ইলিশের প্রাচুর্য পর্যবেক্ষণ করে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকেও দেশে শীত মৌসুমে ইলিশের একটি বর্ধিত মৌসুম ছিল। কিন্তু নির্বিচার জাটকা নিধনের ফলে তা লোপ পায়। এরপর দেশে ইলিশের মাত্র একটি মৌসুম ছিল, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর এ মৌসুমেও হেরফের লক্ষ করা যায়। দেখা যায়, বৃষ্টিপাতে হেরফেরের কারণে তা আগস্টের শেষ থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সরে গেছে।
আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ফিশের ইকোফিশ প্রকল্পের প্রধান ও মৎস্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব বলেন, প্রায় এক যুগ ধরে ইলিশের নতুন নতুন অভয়াশ্রম এলাকা ঘোষণা করা ও সমুদ্রে ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ করার পর ইলিশের উৎপাদনে গুণগত ও পরিমাণগত পরিবর্তন এসেছে। ফলে শীতকালে এত ইলিশ ধরা পড়ছে।
বরিশালের পাইকারি বাজার পোর্ট রোডে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে প্রায় দেড় হাজার মণ ইলিশ এসেছে। এর মধ্যে ৫০ মণ বড়, আর বাকি সব জাটকা। এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ প্রতি মণ ৪৮ থেকে ৫০ হাজার, এক কেজি ওজনের ৪৫ হাজার, ৬০০ গ্রাম থেকে ৯৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি মণ ৩৩ হাজার ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম মণ ২৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা, ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১৩ হাজার, ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম ওজনের প্রতি মণ ৮-১০ হাজার এবং ১২ থেকে ১৪টায় এক কেজি হয় এমন ওজনের ইলিশ প্রতি মণ ৬ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।
বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, কয়েক বছর ধরে বরিশাল বিভাগ দেশের মোট ইলিশের ৬৬ ভাগের জোগান দিচ্ছে। এ পরিমাণ প্রায় সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টন। এতে শীত মৌসুমের বড় একটা অংশ যোগ হচ্ছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিভাগের বিভিন্ন নদ-নদীতে ১৯ হাজার ৫৯১ মেট্রিক টন ইলিশ পাওয়া যায়। ২০১৯ সালে কিছুটা কম থাকলেও এই সময়ে ১৭ হাজার মেট্রিক টনের মতো ইলিশ মিলেছিল। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ৯ হাজার ৬৫৭ মেট্রিক টন, ২০১৭–তে ১২ হাজার ২০ মেট্রিক টন এবং ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ২০ হাজার ৩৪৭ মেট্রিক টন ইলিশ ধরা পড়েছিল। তবে এ বছর শীত মৌসুমে ইলিশের উৎপাদন ২৫ হাজার মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যেতে পারে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলিশ সারা বছর ডিম ছাড়লেও ৮০ শতাংশ ইলিশ ডিম ছাড়ে আশ্বিনের পূর্ণিমায়। সে সময় (অক্টোবর মাস) ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার কারণে মা ইলিশ নিরাপদে ডিম ছাড়ে। ইলিশ যে পরিমাণ ডিম ছাড়ে, তা থেকে মাত্র ২ শতাংশ জাটকা টিকে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে দুটি ধাপ গুরুত্বপূর্ণ। প্রজনন মৌসুমে বেশিসংখ্যক ডিম ছাড়ার জন্য মা ইলিশের নির্বিঘ্ন পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে জাটকা সুরক্ষা করা। কিন্তু এ বছর এ দুটি বিষয় নিশ্চিত করা পুরোপুরি সম্ভব হয়নি।
ইকোফিশ প্রকল্পের ইলিশ বিশেষজ্ঞ জলিলুর রহমান বলেন, দেশে আগেও ইলিশের শীতকালীন একটি মৌসুম ছিল। কিন্তু বংশবিস্তার কমে যাওয়ায় সেটি হারিয়ে যায়। তবে কয়েক বছর ধরে দেশে ইলিশ বৃদ্ধি পাওয়ায় মৌসুমটি ফিরে এসেছে। এখন এ উৎপাদন ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ
পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার সকালে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, এখানে ১২০ মণ ইলিশ এসেছে। এর অর্ধেকই জাটকা। এফবি মায়ের দোয়া নামের একটি ট্রলারের জেলে জামাল হোসেন বলেন, ‘গভীর সাগরে ইলিশের জাল দিয়ে মাছ ধরি। কিন্তু ইলিশের জালে অনেক জাটকা ধরা পড়ে।’
তবে ইকোফিশের বিশেষজ্ঞরা জেলেদের এ যুক্তির সঙ্গে একমত নন। তাঁরা বলছেন, সরকার জাটকা ধরা বন্ধে আগের সাড়ে ৪ সেন্টিমিটার ফাঁসের জালের পরিবর্তে ন্যূনতম সাড়ে ৬ সেন্টিমিটার জাল ব্যবহারের আইন করেছে। এতে জাটকা ধরা পড়ার কথা নয়। নিশ্চয়ই সাগর-নদীতে ছোট ফাঁসের জাল ব্যবহৃত হচ্ছে।
বরিশাল মৎস্য বিভাগের উপপরিচালক আনিছুর রহমান তালুকদার বলেন, ‘নদীতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। তবে এত বড় এলাকায় কমসংখ্যক জনবল দিয়ে নজরদারি করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’