লাউয়াছড়ায় খাওয়ার পানি সংকটে বন্যপ্রাণী
প্রাণ ও প্রকৃতি
নানা প্রজাতির বৃহদাকার গাছগাছালিতে ঘন সন্নিবেশিত থাকলেও গত তিন দশকে লাউয়াছড়া বনের ঘনত্ব অনেক কমে গেছে। দু’দশক আগেও শুষ্ক মৌসুমে ছড়া, খাল ও জলাধারে পানি ছিল। বনের ঘনত্ব কমে যাওয়ায় এখন আর পানি নেই।
বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকসহ বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ ও বৃক্ষরাজি সমৃদ্ধ লাউয়াছড়া উদ্যানটিতে প্রাকৃতিক অনেক গাছ ক্রমাম্বয়ে বিলীন হয়ে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে বনের ছড়া ও খাল শুকিয়ে বন্যপ্রাণীর খাওয়ার পানি সংকট তীব্র হচ্ছে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি ও খাবারের জোগান না থাকার কারণে প্রাণীগুলো লোকালয়ে বেরিয়ে নানা সময়ে মৃত্যুমুখে পড়ছে।
স্থানীয়রা জানান, গত কয়েক দশকে লাউয়াছড়া বনের ঘনত্ব অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। এ বনের পুরোনো মূল্যবান গাছ উজাড় হয়েছে। শুকনো মৌসুমে খাল, ছড়া শুকিয়ে যাওয়ায় বন্যপ্রাণী খাওয়ার পানি সংকটে পড়ছে। খাবার ও পানির তৃষ্ণা মেটাতে বন্যপ্রাণী লোকালয়ে চলে আসছে। গাছ পাচার, মাগুরছড়া গ্যাস কূপ দুর্ঘটনা, বনের ভেতর দিয়ে রেল ও সড়ক পথ নির্মাণ, লেবু-আনারসবাগান স্থাপন, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন, অত্যধিক দর্শনার্থীর বিচরণ ইত্যাদি কারণে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে বন।
লাউয়াছড়া বনঘেঁষা মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি প্রধান জিডিসন প্রধান সুচিয়ান ও লাউয়াছড়া পুঞ্জির বাসিন্দা সাজু মারজিয়াঙ বলেন, আজ থেকে ১৫- ২০ বছর আগেও শুকনো মৌসুমে এখানকার ছড়া ও খালে পানি থাকত। এখন পানি নেই। গাছ কাটার কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে তারা দাবি করেন।
জিডিসন প্রধান সুচিয়ান আরো বলেন, ইতিপূর্বে লাউয়াছড়া সিএমসি কমিটিতে থাকাকালীন ছড়ার কিছু কিছু স্থানে ড্রেজিং করে পানি রাখার জন্যও প্রস্তাব করেছি। তবে সে ধরনের কোনো কাজ হয়নি।
লাউয়াছড়া বন্যপ্রাণী বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯১৭ সালে আসাম সরকার কমলগঞ্জের পশ্চিম ভানুগাছের ১ হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করে। পরবর্তী সময় ১৯২৩ ও ১৯২৫ সালে পর্যায়ক্রমে কালাছড়া ও চাউতলী এলাকাকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৬ সালে ১ হাজার ২৫০ হেক্টর এলাকাকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। লাউয়াছড়ায় ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। আয়তনে ছোট হলেও বিরল প্রজাতির প্রাণীর সংমিশ্রণে এ বনটি জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্ব বহন করে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের লাউয়াছড়া রেঞ্জের প্রাক্তন এক কর্মকর্তা বলেন, ৩৫ বছর আগেও লাউয়াছড়ায় যে বন ছিল সেটি এখন আর নেই। বন ফাঁকা হওয়ায় হুমকির মুখে পড়ছে জাতীয় উদ্যানের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য।
লাউয়াছড়া বনরেঞ্জ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বন্যপ্রাণীর খাওয়ার পানি সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, কিছু লেকে পানি আছে। তবে এগুলো শুষ্ক মৌসুমে বন্যপ্রাণীর জন্য পর্যাপ্ত নয়। খাবার ও পানির সংকট থাকার কারণেই নানা সময়ে অজগরসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী লোকালয়ে বেরিয়ে পড়ে। সংবাদ পাওয়ার পর লোকালয় থেকে উদ্ধার করে লাউয়াছড়ায় আবার অবমুক্ত করা হয়।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, লাউয়াছড়া ও সাতছড়ি উদ্যানে পানির জন্য জলাধার তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। এ বছরই সুফল প্রজেক্ট থেকে দুটি উদ্যানে জলাধার তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বৃষ্টি ও গাছ কমে গেছে আর জনসংখ্যা বেড়ে গেছে। যে কারণে শুষ্ক মৌসুমে উদ্যানের ভেতর পানির কিছুটা সংকট থাকে। তবে পানি না পেলেও প্রাণী গাছের পাতা চিবিয়ে নেয়।