সরাইলের লড়াকু মোরগ হাসলি, দাম ৫০ হাজার
পোলট্রি
গ্রে-হাউন্ড কুকুরের মতোই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার আরেক ঐতিহ্য হাসলি বা আঁচিল মোরগ। মোগল শাসনামল থেকেই এই মোরগ লালন-পালন হচ্ছে সরাইলে। অত্যন্ত জেদি স্বভাবের এ মোরগের পা এবং গলা অন্যসব মোরগ-মুরগির চেয়ে অনেক বেশি লম্বা। পাশাপাশি দামও অন্যসব মুরগির থেকে বেশি। একেকটি মোরগের দাম ৫-৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর উঁচু দেহের এই মোরগকে বলা হয়ে থাকে যুদ্ধবাজ মোরগ। মূলত লড়াইয়ের জন্যই শৌখিনরা এ মোরগ লালন-পালন করেন। গত এক দশকে হাসলি মোরগের লড়াইকারী দলের সংখ্যাও দ্বিগুণ হয়েছে। তবে শৌখিনতার পাশাপাশি কেউ কেউ এখন এ মোরগ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেও পালন করছেন।
জনশ্রুতি আছে, ১৬০০ শতাব্দীতে ইরান থেকে সরাইল পরগনার জমিদার পরিবার সর্বপ্রথম সরাইলে হাসলি মোরগ নিয়ে আসেন। তখন থেকেই হাসলি মোরগের লাড়াই হয়ে আসছে সরাইলে। স্থানীয়ভাবে এটিকে আঁচিল মোরগও বলা হয়। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে সরাইলসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন স্থানে মোরগ লড়াই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
মূলত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়টাতে মোরগ লড়াই বেশি জমে। ঢাকা ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাসলি মোরগের দল এসে লড়াইয়ে অংশ নেন। আবার সরাইলের মোরগগুলোরও ডাক পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে হওয়া লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার জন্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রায় ১০০ পরিবার হাসলি মোরগ লালন-পালনে জড়িত আছে। এর মধ্যে সিংহভাগই সরাইল উপজেলার। এদের মধ্যে শৌখিন মোরগ পালনকারীর সংখ্যা বেশি। আর ১৫-২০টি পরিবার আছে, যারা লড়াইয়ের পাশাপাশি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হাসলি মোরগ পালন করছে। বছরে ৪-৫টি মোরগ বিক্রি করতে পারে একেকটি পরিবার। ঢাকা-সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এসে সরাইল থেকে মোরগ কিনে নিয়ে যায়।
হাসলি মোরগের দৈনন্দিন খাবার তালিকায় থাকে ধান, গম ও ভুট্টাসহ অন্যান্য স্বাভাবিক খাবার। তবে লড়াইয়ের কয়েক মাস আগে থেকে কবুতরের মাংস, কাজু বাদাম, কাঠবাদাম, কিশমিশ ও সিদ্ধ ডিমসহ বিভিন্ন পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হয়।
ঐতিহ্যের ধারক হাসলি মোরগের লড়াইকারী দল সংখ্যা গত এক দশকে দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাজুড়ে ৮-১০টি মোরগ দল রয়েছে। এর মধ্যে সরাইল উপজেলায় আছে চারটি দল। ৭-৮ জন মোরগ পালনকারী মিলে একটি দল গঠন করেন।একেকটি দলে ১০-১৫টি মোরগ থাকে, যেগুলো লড়াই করতে পারে। তবে খেলায় একটি দল থেকে শুধু ৭টি করে মোরগ অংশ নেয়। একটি মোরগকে দুই ঘণ্টা ২০ মিনিট পর্যন্ত লড়াই করতে হয়।
সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ ইউনিয়নের বাসিন্দা মোহাম্মদ মাসুদ জানান, হাসলি মোরগ সরাইলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। এই মোরগের লড়াই দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন সরাইলে আসে। এটি এখন মানুষের বিনোদনের খোরাকে পরিণত হয়েছে।
বংশ পরম্পরায় হাসলি মোরগ পালন করছেন সরাইল উপজেলার কুট্টাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মন মিয়া। লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার পাশপাশি বছরে ৪-৫টি মোরগ বিক্রি করতে পারেন তিনি। মন মিয়া বলেন, ‘আমরা তিন পুরুষ ধরে মোরগ পালন করছি। আমার কাছে এখন লড়াই করতে পারে- এমন ৪টি মোরগ আছে। লড়াই করতে পারা মোরগগুলোর কদর অনেক বেশি। তবে আমি বার্ধক্যজনিত কারণে গত বছর থেকে মোরগগুলোকে আর লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করাতে পারছি না।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের নিউ সোনার বাংলা আঁচিল ক্লাবের সভাপতি ইব্রাহিম শাহ বলেন, হাসলি বা আঁচিল মোরগ সরাইল তথা পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্য। আগে শুধু সরাইলে থাকলেও এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে হাসলি মোরগ লালন-পালন হয়। তবে হাসলি মোরগের এ ঐতিহ্য যেন হারিয়ে না যায়, সেজন্য সরকারি উদ্যোগ দরকার।
সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুল হক মৃদুল বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের তরফ থেকে আঁচিল মোরগের একটি প্রদর্শনী খামার করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রদশর্নীর জন্য এবং খামারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সেই খামারে ৬টি মোরগ রাখা হয়েছে। এই মোরগের বৈজ্ঞানিক নাম এবং কীভাবে এটি এসেছে- বিষয়গুলো সাধারণ মানুষ যেন জানতে পারে সেজন্য বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউ থেকে তিনজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সরাইলে এসেছিলেন। তারা আঁচিল মোরগ পালনকারীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। কীভাবে এই আঁচিল মোরগের জিনোম সিকোয়েন্স সংরক্ষণ করতে পারলে বাংলাদেশ এটার মূল জাত হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি অর্জন করতে পারবে- এটা নিয়ে তারা কাজ করছেন। আমরাও তাদের সহযোগিতা করছি।’