শেরপুরে দখল হচ্ছে বন্যহাতির আবাসস্থল
প্রাণ ও প্রকৃতি
শেরপুরের গারো পাহাড়ের বনভূমি দিনদিন সংকুচিত হয়ে আসছে। এক সময় যেখানে গভীর অরণ্য ছিল এখন সেখানে বাড়িঘর গড়ে উঠেছে। বন বিভাগের শতশত একর পাহাড়ি জমিতে এখন চাষাবাদ হচ্ছে। বেদখল হয়ে যাচ্ছে শতশত একর বনভূমি। ফলে বন্যহাতির বিচরণক্ষেত্রও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভয়ারণ্য না থাকায় ক্ষুধার্ত বন্যহাতির দল খাদ্যের সন্ধানে নেমে আসছে লোকালয়ে। সাবাড় করে চলেছে কৃষকের কষ্টার্জিত খেতের ফসল ও গাছপালা। এতে যেন পাল্লা দিয়েই বাড়ছে হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব। বন্যহাতির তাণ্ডবে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে কৃষকদের জানমাল ও খেতের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বন্যহাতির দল দিনের বেলায় গভীর অরণ্যে আশ্রয় নিচ্ছে। আর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে নেমে আসছে লোকালয়ে। তবে খেতের ধান পেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বন্যহাতির পাদচারণা বেড়ে যায়। এসময় খেতের ফসল ও কৃষকদের জানমাল রক্ষার্থে পাহাড়ি গ্রামবাসী ঢাকঢোল বাজিয়ে, পটকা ফুটিয়ে এবং মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যতই হাতি তাড়ানোর চেষ্টা চলছে ততই বন্যহাতির দল তেড়ে আসছে লোকালয়ে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রায় দুই যুগে হাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন পাহাড়ি গ্রামগুলোতে নারী পুরুষ ও শিশুসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অর্ধশতাধিক মানুষ। আহত হয়েছেন কয়েক শ। এছাড়া মানুষের পাতা ফাঁদসহ নানাভাবে ৩১টি হাতিরও মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে গারো পাহাড়ে হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসন এবং বন্যহাতি হত্যার প্রতিবাদ, হাতির জন্য অভয়াশ্রম এবং বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার দাবিতে মানববন্ধন করে প্রতিবাদ জানিয়েছে শেরপুরের নাগরিক সংগঠন জনউদ্যোগ ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইইডি। ঐ দুই সংগঠন থেকে বলা হয়েছে, ১৯৯৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শেরপুরের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বন্যহাতির আক্রমণে মানুষ মারা গেছেন ৫৮ জন। আর মানুষের হাতে ৩১টি হাতির মৃত্যু হয়েছে।
এসব হাতির বেশির ভাগই মৃত্যু হয়েছে বৈদ্যুতিক ফাঁদ, গুলিবিদ্ধ, নয়তো ধারালো অস্ত্রের আঘাতে। জানা যায়, ভারতের সীমানাঘেঁষা শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় প্রায় ৩৫টি গ্রাম রয়েছে। প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বন বিভাগের জমি রয়েছে ২০ হাজার একর। শতাধিক বন্যহাতি কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে ঐ সব পাহাড়ি জনপদে বিচরণ করছে। বনের জমি দখল করে অবৈধভাবে চাষাবাদ করায় মানুষ ও হাতি দ্বন্দ্ব বেড়ে গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বন্যহাতির পদচারণা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাহাড়ি এলাকার কৃষকদের শতাধিক একর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে না। অনাবাদি হয়ে পড়ে আছে এসব জমি।
শেরপুরের সহকারী বন সংরক্ষক মো. আবু ইউসুফ বলেন, হাতি অত্যন্ত নিরীহ প্রাণী। আমরা চেষ্টা করছি যাতে হাতির কোনো ক্ষতি না হয়। তিনি বলেন, হাতিকে মেরে ফেললে আমরা কোনো ছাড় দেব না। তবে মানুষের জানমালেরও যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকেও সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
তিনি বলেন, মানুষ ও হাতির দ্বন্দ্ব কমিয়ে আনতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া, হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে গারো পাহাড়ে অভয়াশ্রম গড়ে তোলার পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, সীমান্তের গারো পাহাড়ে হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
বন্যহাতির হামলায় নিহত, আহত ও ঘরবাড়িসহ ফসল নষ্ট হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে আর্থিক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি পাহাড়ে হাতিসহ প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় চেষ্টা করছি। তবে স্থায়ী সমাধানে অভয়ারণ্য গড়ে তোলাসহ টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।