‘মাছ হবে বৈদেশিক আয়ের দ্বিতীয় প্রধান উৎস’
মতামত-ফিচার
বিগত ২৮ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পালিত হলো ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২১’। এবারের জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘বেশি বেশি মাছ চাষ করি, বেকারত্ব দূর করি’। মৎস্য চাষের সঙ্গে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন ও বেকারত্ব দূরীকরণের বিষয়টি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত। বাঙালির সংস্কৃতি ও জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে মাছ। দেশের সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের পুষ্টিচাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন ও রপ্তানি আয়ে মৎস্য খাতের অবদান অনস্বীকার্য। মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৩.৫২ শতাংশ, কৃষিজ জিডিপিতে ২৬.৩৭ শতাংশ এবং মোট রপ্তানি আয়ের ১.৩৯ শতাংশ মৎস্য খাতের অবদান। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ ভাগ আসে মাছ থেকে। দেশের প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের বিভিন্ন কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে জনপ্রতি প্রতিদিন ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে ৬২.৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহণ করছে।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ঘোষণা করেছিলেন, ‘মাছ হবে দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ’। মৎস্য খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে মুজিববর্ষ উপলক্ষে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নেত্রকোনা জেলার ‘দক্ষিণ বিশিউড়া’ ও শরীয়তপুর জেলার ‘হালইসার’কে ‘মৎস্য গ্রাম’ ঘোষণা করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মাছ নিয়ে তাদের ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২০’ শিরোনামে প্রকাশিত বৈশি^ক প্রতিবেদনে বলেছে, স্বাদু পানির উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশে^ তৃতীয়। দেশে উৎপাদিত মাছের ৭৫ শতাংশ এখন বাজারজাত করছেন মৎস্যচাষিরা। এ ছাড়া কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ৩০ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছ। দেশীয় মাছ সংরক্ষণে ময়মনসিংহে ‘লাইভজিন’ ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। ফলে দেশীয় মাছ আবার ফিরে এসেছে ভোজনরসিক বাঙালির পাতে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উন্মুক্ত করা হয়েছে নতুন উদ্ভাবিত চতুর্থ প্রজন্মের অধিক উৎপাদনশীল ও দ্রুত বর্ধনশীল ‘সুবর্ণ রুই’। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। বাংলাদেশের ইলিশ ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন’ বা ‘জিআই’ সনদ পেয়ে নিজস্ব পরিচয়ে বিশ^বাজারে স্বমহিমায় হাজির হয়েছে। ইলিশ সম্পদ রক্ষা ও ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে সরকার নানামুখী সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ফলে ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান, মানুষের পুষ্টিচাহিদা পূরণে মাছের গুরুত্ব, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও মাছ চাষে আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন ও দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে জনগণকে আরও সম্পৃক্ত ও সচেতন করা হচ্ছে।
এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে মাছের উৎপাদন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয় ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪১ লাখ ৩৫ হাজার টন এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৬ লাখ ৮১ হাজার টন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৫ লাখ ৫২ হাজার টনে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয় ৪৫.০৩ টন। বাংলাদেশ বিশে^ ইলিশ আহরণে প্রথম, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে পঞ্চম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ। এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে সরকারের মৎস্যবান্ধব নীতি ও সহায়তা, মৎস্য বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং মৎস্যচাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। সরকারের ‘জাটকা নিধন’ ও ‘মা ইলিশ আহরণ’ বন্ধে গৃহীত পদক্ষেপের ফলে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যে ইলিশ উৎপাদন ছিল ২.৯৯ লাখ টন তা বেড়ে ২০১৯-২০ সালে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার টনে। ইলিশ সম্পদ রক্ষায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ লাখ ২ হাজার ৩৩৮টি জেলে পরিবারকে মোট ৬৬ হাজার ৭৯১ টন ভিজিএফ চাল দেওয়া হয়েছে। জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ৩ কোটি কোটি ৫০ লাখ টাকার ‘ইলিশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন তহবিল’ গঠন করা হয়েছে। বৈশি^ক মহামারী কভিড-১৯ মোকাবিলায় উপকূলীয় ৭৭ হাজার ৮২৬ জন প্রান্তিক এবং মাঝারি খামারিকে ৯৯ কোটি ৭০ লাখ ২৭ হাজার টাকা নগদ সহায়তা প্রদান ও ৬ হাজার ৪৩৮ জন মৎস্যচাষিকে স্বল্পসুদে মোট ১৫৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এই করোনাকালে অনলাইন বিক্রয় কেন্দ্র, ভ্রাম্যমাণ মাছ বিক্রয় কেন্দ্র/গ্রোথ সেন্টারের মাধ্যমে মোট ৮৩০ কোটি ৩০ লাখ ২৬ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করা হয়েছে। মৎস্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, রাশিয়া, চীনসহ বিশে^র ৫০টিরও বেশি দেশে ২০০২-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭৬ হাজার ৫৯২ টন মাছ রপ্তানি করে, যার মূল্য ৪ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, ও খুলনায় ৩টি বিশ^মানের মাননিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগার স্থাপন করা হয়েছে এবং প্রণয়ন করা হয়েছে মৎস্য ও মৎস্যপণ্য (পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০২০।
কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত ২০০৮ সালে মৎস্য উপ-খাতে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.০০ শতাংশ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ২০১৫ সালের মধ্যে অর্জিত নির্দিষ্ট আটটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সরকার প্রণীত দারিদ্র্যবিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্যবান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য উপ-খাতকে অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দারিদ্র্যবিমোচনে মৎস্য উপ-খাতের বিশেষ করে মাছ চাষ সম্প্রারণ ও মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য সম্পদের জৈবিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দারিদ্র্যবান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে বেকারের সংখ্যা ২০২১ সালের মধ্যে ১.৫ কোটিতে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বর্তমান দারিদ্র্যসীমাকে ২০ শতাংশ ও চরম দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জনে মৎস্য উপ-খাত বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। স্বল্পপুঁজি বিনিয়োগ ও আধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে দারিদ্র্যবিমোচনে মৎস্য চাষ সূচনা করতে পারে এক সম্ভাবনাময় সোনালি অধ্যায়।
লক্ষ করা প্রয়োজন, মৎস্য চাষের মধ্য দিয়ে দারিদ্র্যদূরীকরণ এবং রপ্তানি আয়ের উপরোক্ত পুরো আলোচনাটিই মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদ-সংক্রান্ত। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের মৎস্য সম্পদের আলোচনা এখানে নেই। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, পৃথিবীর সব মানুষের মোট আমিষ চাহিদার শতকরা ১৫ ভাগ আসে সামুদ্রিক সম্পদ থেকে। সম্প্রতি সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরের মৎস্য সম্পদকে কাজে লাগানোর বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের মতে শামুক, সেল-ফিশ, কাঁকড়া, হাঙর, অক্টোপাস এবং অন্যান্য প্রাণী ছাড়াও শুধু মাছেরই ৫০০ প্রজাতি বিদ্যমান বঙ্গোপসাগরে। ধারণা করা হয়, প্রতি বছর বাংলাদেশে বঙ্গোপসাগরের সহজলভ্য মোট ৮ মিলিয়ন টন মাছের মধ্যে আহরণ করা হয় মাত্র ০.৭০ মিলিয়ন টন মাছ। অন্যদিকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সুনীল অর্থনীতির ২৬টি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে মৎস্য সম্পদ আহরণ অন্যতম। এই পরিস্থিতিতে দেশের অভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের মৎস্য সম্পদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে, সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে জাতির জনক মৎস্য সম্পদের বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ হয়ে ওঠার যে সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন, সেটা সত্যে পরিণত হতে পারে।
লেখক কৃষিবিদ ও সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন
[email protected]
সূত্র: দেশ রুপান্তর