‘মহানন্দা স্মার্ট সিস্টেম’-নিরাপদ মাছ উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশে নতুন দিগন্ত
মৎস্য
নিরাপদ খাদ্য মানুষের অধিকার। উৎপাদিত মাছ ও চিংড়ি খেয়ে কেউ অসুস্থ হবে না- এ প্রত্যাশা সবার। তাছাড়া মাছ ও চিংড়ি হলো আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্য। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে মানসম্পন্ন ও নিরাপদ মৎস্য ও মৎস্য পণ্য উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু চাষ পর্যায়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত, অননুমোদিত এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার উৎপাদিত মাছ ও চিংড়ির গুণগত মান বিনষ্ট ও জনস্বাস্থ্যের জন্য অনিরাপদ করে তোলে।খাদ্য শৃঙ্খলের সকল স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে আন্তক্রিয়ার মাধ্যমে খাদ্যের উৎপাদন থেকে শুরু করে শেষতক ভোক্তাবৃন্দ পর্যন্ত সকল স্তরেই খাদ্যের নিরাপদতা নিশ্চিত করা জরুরি। কেবল নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তার মাধ্যমেই স্বাস্থ খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সাশ্রয় করা সম্ভব। অথচ জেনে শুনে অনিরাপদ খাবার খেয়ে এ জাতি নিশ্চিত পঙ্গুত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মাছ চাষের ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। এতে প্রাকৃতিক-জলজ পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে।মাছ ও মানুষের স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যা দেখা দেওয়ার পাশাপাশি ধ্বংসের মুখে পড়েছে জীব বৈচিত্র্য।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২২ এর বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান ধরে রেখেছে, চাষের মাছে অবস্থান ৫ম । ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪৯.১৫ লাখ মেট্রিক টন, যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের মোট উৎপাদন ২৫ দশমিক ৬৩ লাখ টনের চেয়ে ৮৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি।
তবে মাছ উৎপাদনে শীর্ষে থাকলেও রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণে পিছিয়ে বাংলাদেশ। রপ্তানিতে এখন অবস্থান ২১তম। এক যুগে মাছের উৎপাদন ৮৫ শতাংশ বাড়লেও দাম নাগালের বাইরে। মাছের খাবার খরচ মোট উৎপাদনের ৭০ ভাগের বেশি হওয়ায় এই শিল্পের লাভ দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাই অল্প খরচে অধিক উৎপাদন করার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন মাছ চাষিরা।এ জন্য মাছ চাষে রাসায়নিক এবং এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার হচ্ছে। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিকাশ ঘটছে। যা আমাদের জলজ পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। ফলে এক সময় এন্টিবায়োটিকের মাধ্যমে ক্ষতিকর জীবাণু আর দমন করা যায় না। এ ছাড়া এন্টিবায়োটিক প্রয়োগে তাৎক্ষণিক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা মানবদেহে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ জন্যই রোগ দমনে এন্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে প্রোবায়োটিকের ব্যবহার অধিক যৌক্তিক এবং স্থায়িত্বশীল বলে বিবেচিত হচ্ছে এবং এর ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, রপ্তানি বাধা দূর করতে জোর দেয়া হচ্ছে নিরাপদ মাছ উৎপাদনে।
দেশে বাণিজ্যিকভাবে সর্বপ্রথম প্রোবায়োটিক ভিত্তিক মাছ চাষ শুরু করেছে ইম্প্রেস গ্রুপের (আই এন সি টি এল) প্রতিষ্ঠান মহানন্দা এগ্রিকালচার এন্ড ফিসারিজ লিমিটেড, হবিগঞ্জ। মাৎস্য চাষের অত্যাধুনিক পদ্ধতিকে তারা ‘মহানন্দা স্মার্ট সিস্টেম ‘ বলে আখ্যায়িত করছেন যা একটি এডভান্সড বায়োলোজিকাল একোয়াকালচার সিস্টেম, সম্পূর্ণ প্রোবায়োটিক ভিত্তিক। প্রোবায়োটিক হচ্ছে উপকারী অণুজীব যাদের উপস্থিতিতে ক্ষতিকর অণুজীব দমন করা যায় এবং এদের ক্ষতি করার ক্ষমতাও কমানো যায়। প্রোবায়োটিকের মধ্যে রয়েছে ব্যাসিলাস গ্রুপের ব্যাকটেরিয়া, ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটেরিয়া, নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া, ডিনাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়ার সমাহার। জলজ পরিবেশে প্রোবায়োটিক ব্যবহারের ফলে মাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, চাষকৃত প্রজাতির অন্ত্রে উপকারী অণুজীব বংশবিস্তার করে। বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও ভিটামিন উৎপাদনে সহায়তা করে, ক্ষতিকর জীবাণুর অতিরিক্ত বংশবৃদ্ধি প্রতিরোধে জৈবিক নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া মাছের রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়, বৃদ্ধি সহায়ক হিসেবে কাজ করে, হজমে সাহায্য করে, প্রজননের সাহায্য করে, পানির গুণগত মান উন্নত করে, প্রোটিনের অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করে। এ জন্য রোগ দমনে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে প্রোবায়োটিকের ব্যবহার অধিক যৌক্তিক এবং স্থায়িত্বশীল বলে বিবেচিত হচ্ছে।
এক নজরে নজরে মহানন্দা এগ্রিকালচার এন্ড ফিশারিজ লিমিটেড:
আয়তন ৫৭.৭৬ একর ,পুকুরের সংখ্যা ৩০ টি ,প্রতিটির গড় আয়তন ১.৫০একর, চাষকৃত পুকরের সংখ্যা ২৬ টি, ব্রড পালন ও নার্সারি পুকুরের সংখ্যা ৪ টি । চাষকৃত মৎস্য প্রজাতি: পাংগাস, কৈ, তেলাপিয়া, কার্প, মলা । বাৎসরিক (২০২৩-২৪) মৎস্য উৎপাদন লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে ৮০০ মেট্রিকটন ।
উল্লেখ্য, শুরুতে এই ফার্মে প্রচলিত পদ্ধতিতে পাংগাস, তেলাপিয়া উৎপাদন করা হতো যে খানে গত বছরে উৎপাদন ছিল ৩৫০ মেট্রিক টন। ২০২৩ সাল থেকে খামারে রাসায়সিক ও এন্টিবায়োটিক মুক্ত মাছ চাষের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়, যার ফলে অতীতের সময়ের চেয়ে অধিক ঘনত্বে মাছ চাষ সম্ভব হচ্ছে । প্রোবায়োটিক এর মাধ্যমে রাসায়নিক ও এন্টিবায়োটিক মুক্ত চিংড়ি ও মাছ চাষ ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের ব্যবহারিত একটি বহুল প্রচলিত প্রযুক্তি। মুলত, সেই প্রযুক্তির আদলেই ‘মহানন্দা স্মার্ট সিস্টেম’ এর মাধ্যমে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা হচ্ছে। খামারে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রোবায়োটিক এর মাঝে বায়োচিপ ,বায়োএকোয়া এবং পাওয়ার ফিড অন্যতম।
ফার্ম ফিসারিজ এক্সিকিউটিভ কৃষিবিদ মোহা: আতিক আশহাব জানিয়েছেন, এডভান্সড বায়োলকিজাল পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য তিনি থাইল্যান্ড থেকে আনত ট্রেইনার এর মাধ্যমে ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়েছেন এবং এই পদ্ধতিতে মাছ চাষের সুফল তারা নিজেরাও ভোগ করছেন।
ফার্ম ম্যানেজার কৃষিবিদ ড. বদরুজ্জোহা সরকার জানিয়েছেন তাদের উদ্ভাবিত মাছ চাষের এই পদ্ধতি বাংলাদেশের মাছ চাষের জগতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট অঞ্চলের বেশ কিছু খামারিদের কাছে এই পদ্ধতিতে মাছ চাষের কলাকৌশল ইতোমধ্যে ছড়িয়েছে বলে জানান তিনি।
ফার্ম হেড অব অপারেশন কৃষিবিদ জনাব মো: রফিকুল ইসলাম আকন্দ জানিয়েছেন, কেমিক্যাল ও এন্টিবায়োটিক ছাড়াও যে মাছ চাষ সম্ভব তা আমরা প্রমান করার চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং অনেকাংশেই সফল।সকলের প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভোক্তার খাবারের প্লেটে নিরাপদ মাছ পৌছানো সম্ভব।এই ক্ষেত্রে উৎপাদনকারি,মাছ ব্যাবসায়ী থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত সকলের অংশীদারিত্ব ও সচেতনতা প্রয়োজন।