গো-সম্পদ খাতে উন্নয়নে লাম্ফি স্কিন রোগ দমনে পদক্ষেপ জরুরি
প্রাণিসম্পদ
নিতাই চন্দ্র রায়: ভারত ও মিয়ানমার থেকে গরু আমদানি বন্ধের পর আমাদের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশে গো-সম্পদ খাতে এক অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটেছে। এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কুরবানির ঈদের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পশু বাংলাদেশেই উৎপন্ন হয়।
এ কারণে কুরবানির পশুর জন্য এখন আর তীর্থের কাকের মতো বাংলাদেশকে ভারত ও মিয়ানমারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় না। ফলে একদিকে যেমন আমাদের মাংসের উৎপাদন বেড়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে দুধের উৎপাদন।
এছাড়া গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনে পশুসম্পদ খাতের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। মাংস ও দুধ ছাড়াও জৈব সার উৎপাদনের মাধ্যমে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি এবং প্রাণীর মলমূত্র থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদনেও রয়েছে খাতটির বিশেষ অবদান।
বর্তমান সরকারের প্রাণিসম্পদবান্ধব কার্যক্রম, প্রাণিবিজ্ঞানীদের নতুন উদ্ভাবন ও গবেষণা, মাঠকর্মীদের সঠিক কর্মকান্ড এবং খামারি ও কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদের এই অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটেছে। গ্রামের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে দুগ্ধ খামার।
বিদেশ থেকে প্রেরিত অর্থে গ্রামের বহু উদ্যমী যুবক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গো-খামার তৈরি করে, তা থেকে দুধ এবং মাংসের জন্য পশু বিক্রি করে প্রচুর লাভবান হচ্ছেন। লাল সিন্ধি ও হলস্ট্রেইন ফ্রিজিয়ানের মতো অধিক দুধ প্রদানকারী গাভীও পালন শুরু করেছেন অনেক প্রগতিশীল খামারি। মাংস ও দুধ বিক্রি এবং এর প্রক্রিয়াকরণ কাজে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এককথায় প্রাণিসম্পদ খাতে উন্মোচিত হয়েছে এক বিরাট সম্ভাবনার দ্বার।
কিন্তু সম্প্রতি দেশব্যাপী লাম্ফি স্কিন রোগের (এলএসডি) প্রাদুর্ভাবের কারণে সেই সম্ভাবনা অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। হঠাৎ এ রোগের প্রাদুর্ভাব খামারিদের বড় দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। অনেকে ভয়ে আক্রান্ত পশু পানির দামে কসাইয়ের কাছে বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। ২০১৬ সালের দিকে প্রথম দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা ঝিনাইদহ ও যশোরে গরুর মধ্যে এলএসডি শনাক্ত করা হয়। ২০২০ সালে প্রায় ২৫টি জেলায় এলএসডির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এবার এ ভাইরাস রোগটির বিস্তার আরও বেশি। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের ধারণা, এবার কমপক্ষে ৫০টি জেলায় লাম্ফি স্কিন রোগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তাদের হিসাবে, সারা দেশে সাড়ে তিন লাখের বেশি গরু-মহিষ এই রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঝিনাইদহের ছয় উপজেলায় প্রায় ১০ হাজার গরু এলএসডিতে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে মারা গেছে ৫০০ গরু। সীমান্তবর্তী জেলা মেহেরপুরের পরিস্থিতি আরও খারাপ। ওই জেলায় প্রায় প্রতিটি খামার ও কৃষকের পরিবারেই লাম্ফি স্কিন রোগে আক্রান্ত গরু রয়েছে। অদ্যাবধি ওই জেলায় প্রায় শতাধিক গরু মারা গেছে মারাত্মক ওই রোগে। দেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে নীলফামারী, নাটোর, দিনাজপুর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা এই রোগের হটস্পটে পরিণত হয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ গরু এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। অন্যদিকে যশোরের কেশবপুর উপজেলার সব ক’টি ইউনিয়নের গরু এলএসডিতে আক্রান্ত হয়েছে। টাঙ্গাইলের মধুপুর ও ময়মনসিংহের গৌরীপুরে গবাদিপশুর মধ্যে মহামারী আকারে এলএসডির প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এসব উপজেলায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। প্রতিদিন শুধু প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হচ্ছে শতাধিক গরু-বাছুর।
প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, এলএসডি এক ধরনের ভাইরাসজনিত চর্মরোগ। এটি মশা-মাছি ও খাবারের মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়ায়। আবার আক্রান্ত গরুর লালা খাবারের সঙ্গে মিশে এবং খামার পরিচর্যাকারী ব্যক্তির কাপড়-চোপড়ের মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে। আক্রান্ত গরুর দুধেও এই ভাইরাস বিদ্যমান থাকায় আক্রান্ত গাভীর দুধ খেয়ে বাছুরও আক্রান্ত হতে পারে। এছাড়া আক্রান্ত গরুর সিমেনও এই রোগের অন্যতম বাহন। প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগের লক্ষণ হলো জ¦র। এরপর ত্বকের ওপরে বড় আকারের গুটি তৈরি হয়। মানুষের জলবসন্তের মতো শরীর জুড়েই গুটি তৈরি হয়। কয়েক দিনের মাথায় সেগুলো ফেটে তরল নিঃসৃত হতে থাকে। এর কিছুদিন পর ওই গুটিগুলো ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। এলএসডি সব গরুর ক্ষেত্রে এক রকম হয় না। যেসব গরু প্রথম আক্রান্ত হয়, তাদের ক্ষেত্রে এই রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং মৃত্যুর হার হয় বেশি। আক্রান্ত গরুর শরীরে ফোসকা পড়ে। কোনো কোনো গরুর পা ও অ-কোষ ফুলে যায়। কোনো গরুর গলায় ঘা হয়। কিছু কিছু আক্রান্ত গরুর চামড়ার নিচে পচন ধরে। সঠিক চিকিৎসার অভাবে গরু দুর্বল হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় গরুর মৃত্যুসহ নানা রকম মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়। অনেক গরুর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ে। এতে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে। গর্ভবতী প্রাণীদের গর্ভপাত হতে পারে। রোগের তীব্রতা কম হলে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে এবং তীব্রতা বেশি হলে এক থেকে দেড় মাসে আক্রান্ত গরু সুস্থ হয়ে ওঠে।
গ্রামের বেশিরভাগ কৃষক ও খামারি না বুঝেই হাতুড়ে চিকিৎসক দিয়ে গরুর চিকিৎসা করাচ্ছেন। এর ফলে রোগ সেরে গেলেও দেখা দিচ্ছে নানারকম শারীরিক জটিলতা। দেশের বিভিন্ন আক্রান্ত অঞ্চলের জেলা-উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে গরু নিয়ে ভিড় করছেন বহু কৃষক ও খামারি। কিছু উপজেলায় আক্রান্ত গরুর চিকিৎসায় মেডিকেল ক্যাম্প করা হচ্ছে। দ্রুত রোগটি ছড়িয়ে পড়ায় জনবল সংকটে সেবা প্রদানে হিমশিম খাচ্ছেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা। ওষুধ বরাদ্দও রয়েছে অপ্রতুল। এমন পরিস্থিতিতে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কেই কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং এর বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়কে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে কৃষক ও খামারিদের পাশে দাঁড়াতে হবে। মেডিকেল ক্যাম্পের সংখ্যা ও ওষুধ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সবচেয়ে জরুরি এ রোগ থেকে পশুকে নিরাপদ রাখতে কৃষক ও খামারিদের সচেতন করে তুলতে হবে। করোনা মহামারীর মতো এ রোগ দমনে নানামুখী পরিকল্পনা ও সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন
সূত্র: দেশ রুপান্তর