লালমনিরহাটে ক্ষতিকর তামাক চাষে যুক্ত ১৫ হাজার শিশু
পাঁচমিশালি
তামাক উৎপাদন ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে শারিরীক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। এমন সচেতনতামূলক কোন প্রচারণা না থাকায় লালমনিরহাটে ক্ষতিকর তামাক ক্ষেতে শিশুদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তামাক ক্ষেত গুলোতে তাকালেই দেখা মেলে অসংখ্য শিশুর। ধারণা করা হচ্ছে জেলার প্রায় ১৫ হাজার শিশু তামাক চাষের সঙ্গে যুক্ত।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা মহিষামুড়ী গ্রামে তামাক ক্ষেতে কাজ করছে শিশুরা। বাবা-মায়ের সঙ্গে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তামাক খেতে কাজ করতে হয় তাদের। এখন তামাক গাছে সার মিশ্রিত পানি আর খেতের মাটি সমান করতে হচ্ছে তাদের। কিছুদিন পর ভাঙতে হবে তামাকপাতা। এরপর তামাকপাতা শুকানোর কাজেও থাকবে তারা।
কথা বলে জানা যায়, তামাকে ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে কারও তেমন কিছুই জানা নেই। অভিভাবকরা অসচেতন ও উদাসীন। শুধু কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা মহিষামুড়ী গ্রামেই শুধু নয়, শিশুদের তামাক ক্ষেতে কাজ করার এমন দৃশ্য এখন জেলার প্রতিটি গ্রামের তামাক ক্ষেতে।
লালমনিরহাট জেলা শিশু নেটওয়ার্ক সূত্রে জানা গেছে, শিশুদের দিয়ে তামাকের কাজ করা এ জেলার একটি প্রতিদিনের দৃশ্য। অভিভাবকরা কোনোভাবেই বুঝতে চাচ্ছেন না, তামাকের কাজ করলে শিশুর স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থার চরম ক্ষতি হতে পারে। তামাক মৌসুমে জেলায় প্রায় ১৫ হাজার শিশু তামাক উৎপাদন ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থাকে। বিভিন্ন তামাক কোম্পানির প্রলোভনে প্রলুদ্ধ হয়ে চাষিরা তামাক চাষ করছেন। আর তাদের অসচেতনতায় শিশুদের তামাক খেতে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
তামাক ক্ষেতে কাজ করা শিশু রিয়াজুল, মোস্তাকিন, রিয়াদ, জুলফা সহ কয়েক জনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা বাবার সাথে সকাল বেলা আসে আর বিকাল বেলায় বাড়ি যায়। দুপুরের খাবার টাও খেতে হয় তামাক ক্ষেতে। তামাক ক্ষেতে না আসলে বাবা রাগ করেন। তাই প্রতিদিনেই ক্ষেতে আসে তারা।
অভিভাবক হযরত আলী, রবিউল ও মফিজার রহমান জানান, তামাকের ক্ষেতে কাজ করা একটি পারিবারিক কাজ। পরিবারের সবাইকে নিয়ে কাজ করা হয়। তাহলে তামাক চাষে আশানুরূপ আয় হয়। একজন শ্রমিক নিলে দিন ৪০০ টাকা খরচ দিতে হয়। কিন্তু পরিবারের সবাইকে নিয়ে ক্ষেতে কাজ করলে বাড়তি আর শ্রমিক নিতে হয় না। এতে শ্রমিক খরচ বেচে যায়। তাছাড়া, কৃষক পরিবারের সন্তানকে কৃষি কাজ করতে হবে এটাই স্বাভাবিক। গ্রামে এখন শিশু-বৃদ্ধ সবাই তামাকের কাজ করছে। তামাকপাতা বিক্রি না করা পর্যন্ত আমাদের তামাকের কাজ করতে হয়।
সমাজ সেবক ও তরুণ উদ্যেক্তা মোঃ মমতাজ আলী শান্ত বলেন, স্বাস্থ্য সচেতনতায় পিছিয়ে রয়েছে গ্রামাঞ্চলের মানুষ। বিষবৃক্ষ তামাক চাষে ঝুঁকছে এ অঞ্চলের মানুষ। তামাক চাষ বন্ধে কোম্পানি গুলোর দিকে নজর দিতে হবে। কম সময়ে অধিক লাভের আশায় এ অঞ্চলের মানুষের তামাক চাষ করে থাকেন। তামাকের পরিবর্তে এ মৌসুমে গম, ভূট্টা সহ বিভিন্ন শাক-সবজি চাষ করলে জমি উর্বরতা হারাবে না। এ জন্য কৃষি বিভাগকে কৃষকদের বোঝাতে হবে।
লালমনিরহাট কৃষি সস্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামীম আশরাফ বলেন, এ বছর জেলায় কী পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ হয়েছে তা মাঠ পর্যায়ে নিরুপণ চলছে। তবে গত বছর ৮০ হাজার বিঘা জমিতে চাষ হলেও এ বছর কম জমিতে তামাক চাষ হয়েছে বলে তার ধারণা। তামাক চাষ থেকে কৃষকদের ফিরিয়ে আনতে কৃষি বিভাগ থেকে সচেতনতামূলক প্রচারণা প্রতিনিয়ত চালানো হচ্ছে।
লালমনিরহাট সিভিল সার্জন ডাঃ নির্মলেন্দু রায় জানান, শিশুরা তামাক উৎপাদন ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে তারা শারিরীক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তামাকের নিকোটিনের কারণে শিশুদের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই অভিভাবকদের উচিত শিশুদেরকে তামাক ক্ষেতে নিয়ে না যাওয়া।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, তামাক চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে তামাক কোম্পানিগুলো যাতে সক্রিয় ভুমিকা না রাখে সেজন্য কৃষি বিভাগকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগের চেয়ে তামাক চাষ দিন দিন কমছে। শিশুরা যেন তামাক উৎপাদন ও প্রক্রিয়ার কাজে জড়িয়ে না যায় সেজন্য অভিভাবকদেও সচেতন করার পাশাপাশি স্থানীয পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।