বাংলাদেশে ঋতু পরিক্রমায় আগমন ঘটে শীতের। মানুষের ওপর শীতের প্রভাব ঘটে, হাঁস-মুরগির ক্ষেত্রেও তেমনি প্রভাব পরে। তাই শীতের সময় খামার পরিচালনার ক্ষেত্রে খামারি ভাইদের বিশেষ নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়। শীতের তীব্রতায় তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে ডিম পাড়া মুরগীর ডিম উৎপাদনের হার যেমন কমে যায়, তেমনিভাবে কতগুলো রোগের কারণে বাচ্চা মুরগিও মারা যেতে পারে। এ ছাড়া শীতের সময় ডিম দেয়া মুরগীর শরীরে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা বজায় রাখার জন্য সরবরাহকৃত খাদ্য হতে প্রাপ্ত এনার্জি বেশি ব্যয় করে থাকে। শীতের সময় ঠাণ্ডার কারণে বিভিন্ন বয়সের মুরগির পীড়ন বেশি হয়।
*শীতের প্রারম্ভেই পোলট্রি শেডের যাবতীয় মেরামত কাজ করতে হবে। যেমন ঘরের জানলায় চটের পর্দা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে মুরগিকে রক্ষা করা যায়।
*হাঁস-মুরগি পালনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পোলট্রি শেডের/ঘরের তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্য লিটার ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। যদি পুরা ৩ লিটার থাকে তাহলে পরিবর্তন করে দেয়া ভালো। লিটারের উচ্চতা বাড়িয়ে ৭-৮ ইঞ্চি পুর করে দিতে হবে। শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকার কারণে পোলট্রি শেডে ধুলোবালি বেশি পরিমাণে জমা হয়। লিটারের আর্দ্রতা শতকরা ২৫% ভাগের চেয়ে নিচে নেমে গেলে লিটার থেকে ধুলা উড়তে থাকে; এতে শেডের পাখির ধকল বেড়ে যায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সর্বোপরি শেডে সার্বিক তাপমাত্রা রক্ষা করা।
*শীতকালে দিনের সময় কাল কম থাকায় সূর্যের স্বাভাবিক আলো প্রাপ্তির সময় কম হয়। বিশেষ করে ডিম পাড়া মুরগীর ক্ষেত্রে দিনের আলো হিসাব করে রাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করতে হবে।
*পোলট্রি ব্যবস্থাপনায় লেয়ার/ব্রয়লার পালনের ক্ষেত্রে খাবার নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সঠিক মান অনুযায়ী সুষম খাদ্যের ফর্মুলা তৈরি করে সরবরাহ করতে হবে। অথবা কোনো উন্নত খাদ্য উৎপাদনকারী কোম্পানির খাদ্য খাওয়ানো যেতে পারে। শীতকালে মুরগির দেহে অধিক শক্তি যোগানোর জন্য উপাদানে পরিবর্তন আনতে হবে। খাদ্যে এনার্জির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে এবং রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে পারে। লিটার পুরাতন হলে গুণগত মান ঠিক আছে কিনা সেদিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
*খামারের বিভিন্ন বয়সের ও ভিন্ন ভিন্ন জাতের মুরগিকে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে ভালো কৌশল হলো “অল ইন আউট” বা “একত্র প্রবেশ একত্রে বাহির” পদ্ধতি অনুসরণ করা।
*খামারের প্রতিটি মুরগির জন্য পরিমাণমতো জায়গা রাখতে হবে এবং কম জায়গায় যেন বেশি মুরগি না থাকে সেদিকে খামারীদের লক্ষ রাখতে হবে।
*মুরগির ঘরে শীতের মুক্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে চারটি বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনায় আনতে হবে।
*মুরগির শেডে/ঘরে সর্বত্র বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা। যথাযথ মাত্রায় আর্দ্রতা রক্ষা করা।
*শেডের থেকে এমোনিয়া ও কার্বন ডাই অক্সাইডসহ খারাপ গন্ধ দূর করা।
*গরমের দিনের তুলনায় একটু বেশি খাবার সরবরাহ করতে হবে।
*খাদ্য দেয়ার পরপরই খুব তীক্ষè দৃষ্টিতে একনজরে সকল মুরগিকে শেডের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত অবলোকন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অসুস্থ মুরগি থাকলে চিহ্নিত করে আলাদা ব্যবস্থা নিতে হবে।
*“পানির অপর নাম জীবন” খামারে বিশুদ্ধ পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোনোক্রমেই পুকুর, পাতকুয়ার পানি মুরগিকে খাওয়ানো যাবে না বা খাদ্য ও পানির পাত্র ও অন্যান্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এ সব উৎসের পানি দিয়ে ধোয়া যাবে না। পানির পাত্র কমপক্ষে দিনে দু’বার পরিষ্কার করতে হবে।
*খামারের মুরগিকে যথাযথভাবে এবং নির্দিষ্ট সময়ে টিকা প্রদান করতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রার/খাতায় টিকা দানের তারিখ, শেডের নম্বর, বাচ্চার সংখ্যা, টিকার নাম লিপিবদ্ধ করতে হবে।
*খামারে কোন মুরগির রোগব্যাধি দেখা দিলে তাৎক্ষণিক ভাবে সেগুলোকে আলাদা করে রাখতে হবে। প্রকৃত রোগ শনাক্ত করে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের জন্য সু-চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
*মৃত মুরগিকে যেখানে, সেখানে না ফেলে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে।
*খামারে দর্শনার্থী ও বাইরের লোকজন যাতায়াত বন্ধ করতে হবে।
*খামারের প্রতিদিনের কাজের রেকর্ড রাখতে হবে। খাদ্য প্রদান, তাপমাত্রা, ভ্যাকসিনেশন ও রোগের প্রার্দুভাবের রেকর্ডসহ কখন কোন ঔষধ/টিকা প্রদান করা হলো তার রেকর্ড রাখতে হবে।
*প্রতিদিন মুরগির শেড/ঘরে আলগা ময়লা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করলে রোগ জীবাণু সহজে প্রবেশ করতে পারবে না।
*প্রতিটি শেড/ঘরের সম্মুখে জীবাণুনাশক পাত্র রাখতে হবে এবং ঘরে প্রবেশের পূর্বে পরিচর্যাকারীকে তা ব্যবহার করতে হবে।
*পরিচর্যাকারী মুরগির শেডে প্রবেশের পূর্বে যেন তার পরিধেয় পোশাক পরিবর্তন করে নেয় সে ব্যবস্থা রাখতে হবে।
*মুরগির শেডে/ঘরে যেন কোনো রকম পাখি, ইঁদুর ও অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণী প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে অবশ্যই খামারিকে খেয়াল রাখতে হবে।
*শীতে মুরগির দেহে পরজীবীর আবির্ভাব বেশি ঘটে, সে কারণে পরজীবী প্রতিরোধের আগাম ব্যবস্থা নিতে হবে।
*মুরগির ঝাঁক/দলের মধ্যে দুর্বল, অসুস্থ, ডিম উৎপাদনে অক্ষম, কম ডিম উৎপাদনশীল ও বিকৃত মুরগিকে সবসময় বাঁছাই/ছাঁটাইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
*হাঁস/মুরগি পালনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরামর্শের জন্য আপনার নিকটস্থ উপজেলা/জেলা পশু চিকিৎসা কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে পারেন।
বিমল চন্দ্র সরকার*
* সাবেক সহকারী তথ্য অফিসার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, আঞ্চলিক অফিস, বরিশাল