‘আম অর্থনীতি’ বদলে দিচ্ছে রংপুরের মানুষের জীবন
প্রাণ ও প্রকৃতি
রংপুর অঞ্চলের মানুষ এক সময় ধানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। প্রতি মৌসুমে পাঁচ থেকে ১০ বিঘা জমি ধান চাষ করে উৎপাদন ফলনের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করে কষ্টে জীবনযাপন করতেন তারা। এখন ধানের পরিবর্তে সেই জমিতে আম চাষ করে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন কৃষকরা। রংপুরের এই ‘আম অর্থনীতি’ বদলে দিয়েছে মানুষের জীবন চিত্র।
রংপুর ব্রান্ড হাঁড়িভাঙা জাতের আমকে এখন রংপুরের নতুন অর্থকরী ফসল বলা হচ্ছে। জেলার মিঠাপুকুর, রংপুর সদর, বদরগঞ্জের বিস্তৃত এলাকার হাজার হাজার কৃষক এ আম চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন কৃষক পরিবারগুলো। পরিবারে এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা। কৃষক, দিনমজুর থেকে অনেকেই হয়েছেন আমচাষী। প্রতি বছরই বাড়ছে আম চাষের পরিধি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছর রংপুরের আট উপজেলায় ১ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমির আমগাছে ফলন এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪০০ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে বদরগঞ্জ উপজেলায়।
এরপর রংপুর মহানগর এলাকায় ২৫ হেক্টর, সদর উপজেলায় ৬০ হেক্টর, কাউনিয়ায় ১০ হেক্টর, গঙ্গাচড়ায় ৩৫ হেক্টর, মিঠাপুকুরে ১ হাজার ২৫০ হেক্টর, পীরগঞ্জে ৫০ হেক্টর, পীরগাছায় ৫ হেক্টর ও তারাগঞ্জ উপজেলায় ১৫ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে।
রংপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জ। এর সীমানায় পৌঁছালেই চোখে পড়ে এক নতুন দৃশ্য। কোথাও কোথাও ধানি জমির আইলের চারদিকে সারি করে আমগাছ লাগানো হয়েছে। পথের ধারে, প্রতিটি বাসাবাড়ির পরিত্যক্ত জায়গা, বাড়ির উঠানেও আমগাছ। সব গাছেই প্রায় একই আকারের শত শত আম ঝুলছে।
জেলার মিঠাপুরের আখিরাহাট, পদাগঞ্জ, মাঠেরহাট, বদরগঞ্জের গোপালপুর, নাগেরহাট, সর্দারপাড়া, রংপুর নগরের বড়বাড়ী, সদর উপজেলার শ্যামপুর, লাহেড়ীরহাট, সদ্যপুষ্করিণী ইউনিয়নের বকশিপাড়া, কাঁটাবাড়ি এলাকায় গিয়ে একই দৃশ্য দেখা যায়।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জুন মাসের শুরুর দিকে হাঁড়িভাঙা আম বাজারে আসতে শুরু করবে।
বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর উত্তরপাড়া এলাকার কৃষক আবিজার হোসেন বলেন, এক দোন (২৪ শতক) জমিতে ধান আবাদ করতে পানি, সার, হাল-চাষ, শ্রমিক এবং কাটা-মাড়াই করতে কমপক্ষে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা লাগে। খুব ভালো আবাদ হলে এই জমিতে ধান হয় ২০ মণ, যার মূল্য ১০ থেকে ১১ হাজার টাকা।
তিনি জানান, এক দোন জমিতে আমগাছ থাকে ৪০ থেকে ৪৫টি। কীটনাশক, সার আর শ্রমিকসহ খরচ হয় সর্বোচ্চ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। আম বিক্রি হয় সর্বনিম্ন ৪০ হাজার টাকায়।
সোহেল মিয়া বলেন, এক দোন জমিতে ধান আবাদ করে লাভ তিন হাজার টাকা আর আম বিক্রি করলে লাভ ৩২ হাজার টাকা। তাই ধান চাষ করা হচ্ছে শুধু খাবারের জন্য। আর আম চাষ করা হচ্ছে লাভের জন্য।
গোপালপুর এলাকার আমচাষী আসাদুজ্জামান লিটন জানান, এ বছর পাঁচ দোন (২৪ শতক) জমির ২০০টি আমগাছে মুকুল আসার সময়ই দেড় লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। আরও পাঁচটি বাগান আছে তার। এসব আমবাগানে গত দুই বছর আগেও তিনি ধান চাষ করেছিলেন। আমে লাভ বেশি হওয়ায় ধান চাষ বাদ দিয়েছেন।
মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জ সরদারপাড়া গ্রামের হামিদুল ইসলাম জানান, তার বাড়ির ভিটা এক একর (১০০ শতক) জমিতে। বাড়ির উঠান থেকে শুরু করে ১৫০টি আমগাছ লাগিয়েছেন তিনি।
হামিদুল ইসলামের দাবি, আমে পরিশ্রম ও ঝুঁকি কম হলেও লাভ বেশি। এই জমির আম তিনি কমপক্ষে আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারবেন। তার অন্য কোনো আবাদ নেই। আম বিক্রির টাকা দিয়ে এক ছেলেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছেন।
হাঁড়িভাঙা আমকে ঘিরে বেকারের সংখ্যাও কমেছে রংপুরসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলায়। বিশেষত মিঠাপুকুরের লালপুর, পদাগঞ্জ, তেয়ানিসহ আশপাশের গ্রামের বেকার যুবকরা এখন আম ব্যবসায় জড়িয়ে বেকারত্ব দূর করেছেন।
আজহারুল ইসলাম নামের এক আমচাষী বলেন, আমি আগে কৃষিকাজ করতাম। এখন হাঁড়িভাঙা আমের ব্যবসা করি। গত বছর পাঁচ একর জমির আম আগাম কিনে ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি।
তিনি আরও বলেন, এবার ১০ একর জমির আম কেনা হয়েছে। সব ঠিকঠাক থাকলে ৫০ লাখ টাকার আম বিক্রি করতে পারব।
আরো পড়ুন: নওগাঁয় শুরু হয়েছে আম পাড়া
মিঠাপুকুরের আখিরাহাট এলাকার তাজুল ইসলাম জানান, আট থেকে ১০ বছর আগেও এসব এলাকার মানুষ চরম অভাবে ছিলেন। তিন বেলা তো দূরের কথা, অনেকের এক বেলাও খাবার জুটত না। এলাকার মাটি লাল হওয়ার কারণে এখানে বছরে একবার ধান হতো। বাকি আট মাস জমি পড়ে থাকত। কিন্তু হাঁড়িভাঙা আম তাদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে।
সদরুল ইসলাম নামের এক আমচাষী জানান, এবার আবহাওয়া ভালো থাকায় প্রচুর আম ধরেছে। কিছুদিন আগের শিলাবৃষ্টিতে কিছুটা ক্ষতি হলেও সঠিক সময়ে বাজারজাত করতে পারলে এলাকার হাজার হাজার আমচাষী লাভবান হবেন।
রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, রংপুরে এখন ব্যাপকভাবে হাঁড়িভাঙা আম চাষ হচ্ছে। কৃষি বিভাগ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছে। তিনি বলেন, খুব একটা পরিশ্রম ও অর্থ খরচ না হওয়ায় মানুষ আম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
মাসুদুর রহমান আরও বলেন, রংপুরের আট উপজেলায় এ বছর ১৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরোধান আবাদ হয়েছে। অন্যদিকে হাঁড়িভাঙা আম চাষ হয়েছে ১ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। এছাড়াও ৩ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে অন্যান্য জাতের আম।
রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, আম বাজারজাতে যাতে কোনো ধরনের অসুবিধা না হয় এবং পরিবহনে ব্যবসায়ীদের কোনো হয়রানির শিকার হতে না হয়, সেজন্য আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলব। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। সূত্র: যুগান্তর