১:১৬ পূর্বাহ্ন

সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর , ২০২৪
ads
ads
শিরোনাম
প্রকাশ : এপ্রিল ১৯, ২০২৩ ৯:০৩ পূর্বাহ্ন
গরমে পোল্ট্রির বাড়তি যত্ন নিবেন যেভাবে
পোলট্রি

প্রাণীজ আমিষের বড় একটা অংশ আসে পোল্ট্রি শিল্প হতে। প্রায় অর্ধ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। তাই এ শিল্পের সুদৃঢ় ভবিষ্যত চিন্তা করে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। গরম কাল এ পোলট্রি খামারের বিশেষ যত্ন না নিলে কমে যেতে পারে ব্রয়লারের ওজন বৃদ্ধি এবং লেয়ার খামারের ডিম সংখ্যা। সে কারণেই নিচের টিপসসমূহ খামারি ভাইদের খুবই কাজে লাগবে:

পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও এর প্রভাব: ঘর্মগ্রন্থি না থাকার কারণে মোরগ-মুরগির অতিরিক্ত গরম অসহ্য লাগে। এতে উত্পাদন ক্ষমতা ব্যাহত হয়। অতিরিক্ত তাপে এদের পানি গ্রহণ, শ্বাস-প্রশ্বাস, শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে থাইরয়েড গ্রন্থির আকার, রক্তচাপ, নাড়ির স্পন্দন, রক্তে ক্যালসিয়ামের সমতা, খাদ্য গ্রহণ, শরীরের ওজন ও ডিমের উত্পাদন হ্রাস পায়। ১৫ হতে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এদের উত্পাদন সর্বোচ্চ। ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে শতকরা ৪ ভাগ হারে পানি গ্রহণ বৃদ্ধি পায়। ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পর হতে ডিমের সংখ্যা না কমলেও প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ডিমের ওজন শতকরা এক ভাগ হারে কমে যায়। ২৬.৫ সেলসিয়াস ডিগ্রি তাপমাত্রার পর হতে মোরগ-মুরগির খাদ্যের রূপান্তর ক্ষমতা হ্রাস পায়। ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে প্রতি ডিগ্রি তাপ বৃদ্ধিতে ২ হতে ৪ শতাংশ খাবার গ্রহণ কমে যায়। ৩৬ হতে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা মোরগ-মুরগির জন্য অসহনীয় এবং ৩৮ ডিগ্রির পর মৃত্যু হার খুব বৃদ্ধি পায়।

তাপজনিত ধকল প্রতিরোধে করণীয়: খামারের আশে পাশে ছায়াযুক্ত বৃক্ষ রোপণ এবং ঘর পূর্ব-পশ্চিমে হওয়া বাঞ্চনীয়। তবে আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনায় বায়োসিকিউরিটির কথা চিন্তা করে গাছপালা রোপণের প্রতি অনুত্সাহিত করা হয়ে থাকে। গরমে পোল্ট্রি শেডে প্রত্যক্ষ সূর্যালোক পরা যাবে না। অত্যধিক গরম প্রতিরোধে প্রয়োজনে শেডের ছাদে/বা টিনের চালায় দিনে দু’তিন বার পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। টিনের নিচে চাটাই/হার্ডবোর্ড দিয়ে সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক সময় মুরগি যখন হাঁ করে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় তখন ঘরে সেপ্র মেশিন দিয়ে কুয়াশার মত করে পানি ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে। পানির ড্রিংকার ও ফিডারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ঘন ঘন ড্রিংকারের পানি পাল্টাতে হবে। গরমে বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যাওয়ার কারণে শেডের মেঝে অনেক সময় স্যাঁতসেঁতে হয়ে লিটার দ্রুত ভিজে যায়। ফলে রোগের আক্রমণও বাড়ে। সেজন্য প্রতিদিন সকালে ব্রয়লার শেডের লিটার উলোট-পালোট করা প্রয়োজন। লিটারে গুঁড়ো চুন ব্যবহার করলে খুব ভাল ফল পাওয়া যায়। শেড হতে শেডের দূরত্ব ৩০ ফুটের অধিক হলে ভাল হয়। শেডে মোরগ-মুরগির ঘনত্ব বেশি হলে তা কমিয়ে দিতে হবে। বাতাসের অবাধ চলাচল শেডের ভেতরের তাপমাত্রা শীতল রাখতে সাহায্য করবে এবং পোল্ট্রির জন্য ক্ষতিকর অ্যামোনিয়া গ্যাস মুক্ত রাখবে। শেডে স্টেন্ড ফ্যানের ব্যবস্থা করতে হবে।

গরমে পোল্ট্রি খামারে খাবার ব্যবস্থাপনা: ঠাণ্ডা ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। যেহেতু তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে এদের খাদ্য গ্রহণ কমে যায়, সেহেতু প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা মেটাতে ৮ হতে ১০ ভাগ শক্তি কমিয়ে প্রোটিন, খনিজ লবণ ও ভিটামিন বাড়িয়ে দিতে হবে। প্রতি লিটার পানিতে ১০-১২ গ্রাম গ্লুকোজ ও মুরগি প্রতি ১০ গ্রাম ভিটামিন সি পানির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে ভাল ফল পাওয়া যায়। এছাড়া প্রাকৃতিক বিটেইনে ধনাত্মক ও ঋনাত্মক আছে যা কোষের মধ্যে পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে। ফলে হিট স্ট্রোকের হাত থেকে এরা রক্ষা পায়। গরমে পোল্ট্রির অ্যামাইনো এসিডের চাহিদা বেড়ে যায়। বিটেইনে মিথাইল মূলক বিদ্যমান, যা মিথিওনিন ও কলিনের ঘাটতি পূরণে সহায়তা করে। গরমে প্রয়োজনে একদিনের বাচ্চার জন্য পানিতে আখের গুড়, ভিটামিন সি অথবা ইলেকট্রোলাইট যুক্ত স্যালাইন পানি দিতে হবে।
লেখক: ডা. সুমন তালুকদার (রুনু) , সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

প্রকাশ : জুন ১৩, ২০২২ ২:১৭ অপরাহ্ন
ভালুকা সরকারি কলেজ এর গৌরবোজ্জ্বল ৫০ বছরের পথ চলায় আমার আন্তরিক অভিনন্দন – কৃষিবিদ দীন মোহাম্মদ দীনু
মতামত-ফিচার

ভালুকার ঐতিহ্যবাহী সর্ববৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ভালুকা সরকারি কলেজ’ ইতোমধ্যেই তার গৌরবময় ৪৯ বছর অতিক্রম করে আজ ১৩ জুন ২০২২ তারিখে ৫০ বছরে পা রাখছে। গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার কাজে গত ৪৯ বছর এ বিদ্যাপীঠের প্রতিথযশা শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সকলে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এ জন্য সুবর্ণজয়ন্তীর এ মাহেন্দ্রক্ষণে এ প্রতিষ্ঠানটির সম্মানিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই ।

কলেজটি প্রতিষ্ঠায় সেকল বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের নাম জড়িয়ে আছে তারা সকলেই আমার পিতৃতুল্য পরম শ্রদ্ধেয় ,আজকের এই দিনে তাদেরকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি। তারা আমাদের অহংকার । যদিও এ প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাইনি তারপরও অন্তর থেকে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি রয়েছে আমার গভীর টান ও আবেগ । ভালুকার সর্ববৃহৎ ও পথিকৃৎ এ- বিদ্যাপীঠে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ অব্যাহত রেখে কলেজটি উচ্চশিক্ষার পরমোৎকৃষ্ট কেন্দ্র হিসেবে তার কর্মকান্ড অব্যাহত রাখবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনজীবিকার উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামবাংলার সংস্কৃতি বিকাশের ধারাকে কলেজটির শিক্ষক, শিক্ষার্থীবৃন্দ অব্যাহতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে – এটাই আজ আমার প্রত্যাশা। আমি ভালুকা সরকারি কলেজ এর উত্তরোত্তর আরও সমৃদ্ধি কামনা করছি।

শেয়ার করুন

প্রকাশ : জুন ৯, ২০২২ ৮:২৭ পূর্বাহ্ন
কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তায় বিশ্ব
কৃষি বিভাগ

গত ১৮ মে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ব দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে। ইউরোপের ‘শস্য ভান্ডার’ বলা হয় ইউক্রেনকে। বিশ্বের খাদ্যশস্যের বড় রপ্তানিকারক রাশিয়া এবং ইউক্রেন। চলমান যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্যসংকট তীব্রতর হচ্ছে।

বিশ্ববাজারে গমসহ অনেক খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে গেছে। ইতোমধ্যে ভারত গম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় সার রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। যুদ্ধাবস্থা দীর্ঘায়িত হলে বৈশিক বাজারে সারের সংকট দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশকে খাদ্যশস্যের বড় একটা অংশ আমদানি করতে হয়; অন্যদিকে কৃষিতে যে সার দরকার হয়, তার একটি বড় অংশও আমদানির ওপর নির্ভরশীল। কাজেই এ দুটি বিষয় আমাদের কৃষি এবং খাদ্য সরবারহের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে—এটি সহজেই অনুমেয়। তাৎক্ষনিক প্রভাব না পড়লেও সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনা করে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে।

প্রথমত, আমরা সার উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। দেশে রাসায়নিক সারের বিপুল চাহিদা থাকায় সার সরবরাহের ক্ষেত্রে আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরো কিছুদিন চলতে থাকলে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্ববাজারে সারের দাম বাড়বে। সেজন্য আমাদের অভ্যন্তরীণ সার উৎপাদনের পরিমাণ বাড়াতে হবে। জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য কৃষকদের পর্যাপ্ত সহায়তা দিতে হবে। কোনোভাবেই যেন সারের অপচয় না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তাছাড়া অনেক সময় কৃষকেরা বুঝতে পারেন না কোন জমিতে কতটুকু সার দিতে হয়। তিউনিসিয়া, মরোক্কোসহ যেসব দেশ থেকে আমরা সার আমদানি করে থাকি তাদের সঙ্গে আগে ভাগেই তিন অথবা পাঁচ বছর মেয়াদি চুক্তি করা যেতে পারে, যেন কোনোভাবেই রাসায়নিক সারের সংকটে উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত না হয়।

দ্বিতীয়ত, ক্রমেই আমাদের কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। আশার কথা হচ্ছে, নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবনের ফলে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পূর্বে যে জমিতে ২০ মণ ধান হতো সে জমিতে এখন ৩৫-৪০ মণ ধান হচ্ছে। একই সঙ্গে দুঃখের কথা হচ্ছে, দেশে উদ্ভাবিত উন্নত জাতের ফসলগুলো প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। এখনো সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ হচ্ছে অনেক জায়গায়। কৃষি জমির পরিমাণ চাইলেই বাড়ানো সম্ভব নয়, তাই উত্পাদনশীলতার ওপর জোর দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। যেহেতু বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট তীব্রতর হচ্ছে, সেহেতু আমাদের আগে থেকে পদক্ষেপ নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে চেষ্টা করতে হবে। উন্নত জাতের ফসলের বীজ দেশের সর্বস্তরের কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ২০২১-২২ অর্থবছরে কৃষিখাতে মোট ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আসন্ন বাজেটে কৃষি খাতে প্রণোদনা আরো বাড়াতে পারলে ভালো হবে।

মোটকথা, কৃষিসেবা জোরদার করতে হবে। কৃষি প্রণোদনা বাড়াতে হবে। কৃষকের দোর গোড়ায় কৃষিসেবা পৌছাতে হবে। ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হবে। মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা দায়িত্ব সহকারে কাজ করছেন কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। সেবা পেতে অসুবিধা হলে হট লাইন নম্বরে কল করে অভিযোগ জানানোর সুযোগ রাখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান কমছে, অথচ দেশের ১৮০ মিলিয়ন লোকের খাদ্য সরবারহ করছে কৃষি। তাই আমাদের কৃষির ওপর জোর দিতে হবে। কোনোভাবেই যেন আমাদের খাদ্যসংকটের মুখোমুখি হতে না হয়। সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ে দশ ফোঁড়। কাজেই যা করার এখনই করতে হবে।

মো. শহীদুল ইসলাম
লেখক :শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র:ইত্তেফাক

শেয়ার করুন

প্রকাশ : জুন ৬, ২০২২ ১২:২৮ অপরাহ্ন
টেকসই উন্নয়নে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক
কৃষি বিভাগ

দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমাদের নারীদের অবদান কম হলেও, গ্রামীণ অর্থনীতিতে পুরুষের তুলনায় নারীর অবদান তুলনামূলকভাবে বেশি এবং এর পরিমাণ প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলের নারীরা তাদের গৃহস্থালির যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সক্রিয়ভাবে পারিবারিক দায়িত্ব হিসেবে কৃষিকাজে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছে। বর্তমানে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ ও অবদান দুই-ই বাড়ছে। নারীদের এ অংশগ্রহণ জিডিপি’র প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে, বিশেষ করে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা- দারিদ্র্যমোচন এবং জেন্ডার সমতা অর্জনেও কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক।

আমাদের দেশের অর্থনীতির অবকাঠামো পরিবর্তনের কারণে শিল্প ও সেবাখাতের অনুপাত কৃষিখাতের তুলনায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে গ্রামীণ অর্থনীতি এখনো পুরোটা কৃষিনির্ভর, যার অনেকটাই নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের হাতে ধরে। দেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গ্রামীণ অর্থনীতি কৃষি এবং কৃষিতে নারী উদ্যোক্তাদের অবদান-এ দুই-ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই কৃষি যেমন নারীর হাতে, তেমনি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও নারীর হাতে। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারীর অংশগ্রহণ যেমন অত্যাবশ্যক, তেমনি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও নারীর সরাসরি সম্পৃক্ততা অত্যাবশ্যক।

স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। এর ফলে ২০২৪ সালে জাতিসঙ্ঘ সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষিত হবে। জাতিসঙ্ঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ উল্লেখ্যযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। এমডিজি বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায় থেকে নেয়া অভিজ্ঞতা পরবর্তী পর্যায়ের জন্য নেয়া পরিকল্পনা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নেও সাফল্যের উদাহরণ সৃষ্টির পথে বাংলাদেশ।

জাতিসঙ্ঘ টেকসই উন্নয়ন প্রতিবেদন-২০২১ অনুযায়ী এসডিজি অর্জনে বিশ্বের যে তিনটি দেশ সবচেয়ে এগিয়ে আছে, তারমধ্যে সবার ওপরে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যতা ও বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতি সচল থাকার কারণেই উৎপাদন ব্যবস্থার অবস্থান অনেকটা ভালো রয়েছে, আর এর কারণ হলো কৃষিখাতে নারী শ্রমিক ও নারী উদ্যোক্তার অংশগ্রহণ বৃদ্ধি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কৃষি খাতের উপর নির্ভরশীল। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষি খাতের অবদান প্রায় ১৪ শতাংশ। শিল্প ও সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও কৃষি খাতের পরোক্ষ অবদান রয়েছে। দেশের মোট শ্রমজীবীর প্রায় ৪১ শতাংশ প্রত্যক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। কৃষিখাতের উন্নয়নের সাথে দেশের বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাই খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিতকরণ, দারিদ্র্যমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৃষিখাতের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। আর অন্যতম অংশীদার এ খাতের নারী শ্রমিক ও উদ্যোক্তারা, বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারীর সময় গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতি সচল রাখতে এ খাতের নারীরা ব্যাপক অবদান রেখেছেন।

টেকসই উন্নয়নের ধারা তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ, নারীর ক্ষমতায়ন, পণ্য উৎপাদন ও বিপণনে অংশগ্রহণ এবং দারিদ্র্যমোচন অব্যাহত রাখতে এবং নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের অবদানকে ধরে রাখতে সরকার প্রণীত বিভিন্ন নীতি, আইন, বিধি-বিধানসহ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিওদের নানা কর্মসূচি ও কর্যক্রম লক্ষ্যে পূরণে এসাথে চলমান রয়েছে।

গত কয়েক দশকে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে কয়েক কোটি শ্রমশক্তি নতুন যোগ হয়েছে, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশিই নারী। আর এই নারীর বেশির ভাগই কৃষি খাতের নারী শ্রমিক এবং উদ্যোক্তা। নতুন এ সকল নারী উদ্যোক্তা মূলত গবাদিপশু পালন, হাঁসমুরগি পালন, মৎস্য চাষ, শাকসবজি-ফলমূল উৎপাদনসহ ধান, পাট গম চাষাবাদে নিয়োজিত রয়েছে। মূলত গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে গতি আনতে নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের ভূমিকাই মুখ্য।

স্বাধীনতার পরে সত্তর ও আশির দশকের দিকে গ্রামীণ নারীরা বাড়ির বাইরে গিয়ে কৃষিকাজ অংশগ্রহণ কমই করতো। তবে নব্বইয়ের দশক থেকে নারীরা কৃষিকাজে বীজ সংরক্ষণ, জমি প্রস্তুত, চারা রোপন, ফসল কাটা এবং ফসল ঘরে তোলাসহ সকল কাজের সাথে যুক্ত। তবে অনেক আগে থেকে বাড়ির গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালনের সাথে নারীরা জড়িত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে নারীরা বাণিজ্যিকভাবে কৃষি উৎপাদন ও বিপণনে নারীরা ব্যাপকভাবে জড়িত। মাছ চাষ, মৌমাছি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, ফলমূল চাষ থেকে শুরু করে বাণিজ্যিকভাবে দেশি-বিদেশী নানা জাতের সবজি উৎপাদনের বিশাল কর্মযজ্ঞে আজ নারীরা সমান অংশীদার।

পরিসংখ্যান বলছে, বৃহত্তর কৃষি অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। গত ৫০ বছরে কৃষিতে নারীর সংখ্যা শতকের ঘর থেকে কোটিতে পৌঁছে গেছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুসারে, কৃষিতে এখন নারীর অংশগ্রহণের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

দেশে মোট শ্রমশক্তির উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে নারী। নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্যখাতে জড়িত। কর্মক্ষম নারীদের বেশির ভাগ কৃষিকাজে নিয়োজিত। ফসলের প্রাক বপন থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন পর্যন্ত সম্পূণ প্রক্রিয়ায় নারী এককভাবেই করে। বাড়ির বাইরে ফসল ও সবজি চাষ, মসলা উৎপাদন, শুঁটকি ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ, মাছ ধরার জাল তৈরি ও মেরামত, পোনা উৎপাদন, গবাদিপশু, হাঁসমুরগি গবাদিপশু পালনের কাজও নারীরা আজ প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। সামাজিক বনায়নের কাজও হয় নারীর হাত দিয়ে।

নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার কারণে কৃষি পণ্য উৎপাদনে ডাইভারসিফিকেশন (বৈচিত্র্য) বেড়েছে। নারীরা বসতবাড়ির আঙ্গিনায় বাণিজ্যিকভাবে দেশি-বিদেশি উন্নত ফলনশীল শাক-সবজি ও ফলমূলসহ নানা জাতের কৃষিপণ্য উৎপাদন করছে। কৃষি অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, কৃষিকাজ বলতে এখন আর শুধু মাঠে ফসল চাষাবাদকেই বোঝায় না, বরং বোঝানো হয় শস্য উৎপাদন, গবাদিপশু পালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, শাকসবজি, ফলমূল চাষ ও বনায়ন বা বাড়ির আশপাশে এমনকি বাড়ির ছাদেও গাছ লাগানো ইত্যাদি। এ বিবেচনায় এ সময় কৃষিতে পুরুষের তুলনায় নারী অংশগ্রহণ আগের তুলনা অনেক বেড়েছে। পুরুষরা মূলত শহরে পড়াশোনা, চাকরি ও ব্যবসার দিকে বেশি ঝুঁকে যাওয়া গ্রামীণ কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। পুরুষদের মধ্যে যতসংখ্যক পুরুষ কৃষিকাজে যুক্ত, তার চেয়ে নারী কর্মজীবীদের মধ্যে অনেক বেশিসংখ্যক কৃষিকাজে যুক্ত।

কৃষি উদ্যোক্তাদের নানাবিধ সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদেরকে । উদ্যোক্তা হিসেবে আর্থিক সংকট, ঋণ না পাওয়া, ভূমির মালিকানায় সম-অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বিপণন ব্যবস্থার অভাব এবং গ্রামীণ হাট-বাজারে প্রবেশেসহ যোগাযোগ অবকাঠমো ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকার করণে নারীরা কৃষি খাতে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত হয় না বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান (এনজিও) থেকে চড়া সুদে ঋণ গ্রহণের কারণে তাদের নানাবিধ জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি ঋণ ব্যবস্থাকে আরো সহজীকরণসহ পর্যাপ্ত করতে হবে। উৎপাদিত পণ্যের সঠিক বিপণনের জন্য নারীদের জন্য বিশেষ বাজার স্থাপনসহ অনলাইনে বাজার বিপণন ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারাও যাতে অনলাইন বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাদের তৈরিকৃত পণ্য বাজারজাত করতে পারেন- এজন্য প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষ করে তুলতে হবে।

কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। কৃষি এবং কৃষকরাই বাংলাদেশর গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদন্ড। সরকার গৃহীত বিভিন্ন উন্নয়ন দলিল, বিশেষ করে রূপকল্প-২০২১, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি), সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাস্তবায়নের কৌশল অনুসরণে করে জাতীয় কৃষি নীতি- ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। কৃষি খাতকে টেকসই ও সমৃদ্ধ করতে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কৃষিবান্ধব উদ্যোগের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকও দেশের কৃষি খাতকে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর পাশাপাশি সরকারি চাকুরি ও কৃষিক্ষেত্রে আরো অধিক সংখ্যক নারী কৃষক এবং কৃষি শ্রম-শক্তি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হওয়া প্রয়োজন । কৃষি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে নারীর অবদান রাখার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, তাই কৃষি সংক্রান্ত অর্থোপার্জন কর্মকাণ্ডে নারীকে অর্থবহভাবে সম্পৃক্ত করে এবং মানব-সম্পদ উন্নয়নে সরকার নারীর ক্ষমতায়ন; উৎপাদন ও বিপণনে অংশগ্রহণ এবং আয়ের সুযোগ সৃজন তৈরির ওপর আরো অধিক গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।

যেকোনো দেশের নারীদের বাদ দিয়ে বা অবহেলা করে, দূরে রেখে কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কখনোই সফল হবে না। তাই সারা বিশ্ব আজ অনুধাবন করতে পেরেছে, নারীর সামগ্রিক উন্নয়ন ছাড়া সমগ্র বিশ্বের উন্নয়ন সম্ভব নয়, তাই এসডিজি অর্জনে নারীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সম্পৃক্ততা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারী। সেই বিবেচনায় এ দেশের জন্য উন্নয়ন কার্মকাণ্ড তথা কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ আরো বেশি জরুরি। আগের তুলনায় দেশে নারী-পুরুষের মধ্যকার ব্যবধান বা জেন্ডার গ্যাপ কমে আসছে। আয় উপার্জনক্ষম কাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। নারীর অংশগ্রহণ বাড়ায় নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য কমে আসছে। তাই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও কৃষিতে নারীর সরাসরি সম্পৃক্ততা অত্যাবশক।

লেখক : সিনিয়র তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা

সূত্র:নয়া দিগন্ত

শেয়ার করুন

প্রকাশ : অক্টোবর ৩১, ২০২১ ৭:২৫ অপরাহ্ন
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যের ১৫ বছর
মতামত-ফিচার

কৃষিবিদ খসরু মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনঃ সাফল্যের ১৫ বছর অতিক্রম করল সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। টিলা ও সমতল ভূমি ঘিরে নগরীর আলুরতল এলাকায় কৃষিক্ষেত্রে শিক্ষাদান ও দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরির লক্ষ্যে ২০০৬ সালের ২রা নভেম্বর যাত্রা করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি কৃষিক্ষেত্রে দেখিয়েছে অনন্য সাফল্য। বর্তমানে ৬টি অনুষদে ৪৭টি বিভাগ রয়েছে। প্রায় ৫০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা সিকৃবি ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে ছোট-বড় টিলা। সিলেট-জাফলং-তামাবিল বাইপাস রাস্তার পাশে ১২ একর ২৯ শতক ভূমি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিঃক্যাম্পাস ও গবেষণা মাঠ গড়ে তোলা হয়েছে। বিসিএস পরীক্ষাসহ দেশে-বিদেশে আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা আজ সফল। ভাবতে ভালই লাগছে এরা সবাই এখন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ উজ্জ্বল করে আছে এবং বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধুর সম্পর্কের কারণেই তারা আজ সফল হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় চলছে গবেষণা কার্যক্রম। যার স্বীকৃতিস্বরূপ বৈশ্বিক কোভিড-১৯ মহামারীর সময়েও আন্তর্জাতিক স্কোপাস ইনডেক্স জার্নালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ১০০ এর অধিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনায় হাওরে জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে এখানকার গবেষকরা। বোরো ফসলনির্ভর হাওরাঞ্চলে এক সময় শীতকালেও মাঠের পর মাঠ পতিত থাকত। সুনামগঞ্জের হাওরসহ বিভিন্ন হাওরের প্রান্তিক কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে সিকৃবি নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে। চলছে মসলা জাতীয় ফসল নিয়ে গবেষণা। প্রোটিন সমৃদ্ধ সিকৃবি শিম-১ ও সিকৃবি শিম-২ জাত দুইটি সিলেট অঞ্চলে বছরব্যাপী প্রোটিনের চাহিদা মেটাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সিলেট অঞ্চলের কৃষি আবহাওয়া সম্পর্কিত তথ্য জানার জন্য স্থাপন করা হয়েছে অটোমেটেড এগ্রোমেটিওরোলজিক্যাল স্টেশন। কৃষিক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও গবেষণা করে চমক দেখিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এ জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। হাওরে দারিদ্র্য বিমোচনে আগাম ধান চাষে সাফল্য, সিলেটের আবহাওয়া অনুযায়ী গ্রীষ্মকালীন শিম ও টমেটোর জাত উদ্ভাবন, আধুনিক ক¤িপউটার ভিশন এর মাধ্যমে চায়ের ইমেজ প্রসেসিং প্রযুক্তির দ্বারা চায়ের চারটি গ্রেড নির্ভুলভাবে নির্ণয়ের পদ্ধতি উদ্ভাবন, স্বয়ংক্রিয় সেচ যন্ত্র উদ্ভাবন, উলম্ব ভাসমান খামারে (ভার্টিক্যাল ফ্লটিং বেড) একক স্থান হতে অধিক ফসল উৎপাদন করে ক্রম-হ্রাসমান ভূমির উপর চাপ কমানোর প্রযুক্তি উদ্ভাবন, মাছের মড়ক রোধে ভ্যাক্সিন উদ্ভাবনসহ নানাবিধ গবেষণার পাশাপাশি বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ রক্ষায় চলছে গবেষণা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোঃ বদরুল ইসলাম শোয়েব জানান যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা, গবেষণা এবং প্রশাসনিক সকল কার্যক্রম চালিয়ে নিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সহ বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলেই কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, এখানকার গ্র্যাজুয়েটরা শিক্ষা গবেষণার পাশাপাশি শিল্প সংস্কৃতিতে এগিয়ে রয়েছে এবং দেশ বিদেশে মেধার স্বাক্ষর রাখছে। ডিন কাউন্সিলের আহবায়ক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রাশেদ আল মামুন বলেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রতিযোগীতায় টিকে থাকতে পারে সেই লক্ষ্যে কোভিড-১৯ মহামারীর সময়েও সরকারী নির্দেশনা মোতাবেক পাঠদান ও পরীক্ষাসমূহ অব্যাহত রয়েছে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মোঃ মতিয়ার রহমান হাওলাদার জানান সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ বছরের একটি অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনার পাশাপাশি ৩০ বছরের একাডেমিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিভিন্ন অনুষদে অত্যাধুনিক গবেষণাগার স্থাপন করা হয়েছে। এ কারণে করোনাকালীন সময়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনাসহ অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। সবার সহযোগিতা পেলে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।

 

লেখকঃ

কৃষিবিদ খসরু মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন

অতিরিক্ত পরিচালক
জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তর
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
সিলেট-৩১০০।

শেয়ার করুন

প্রকাশ : অক্টোবর ১৬, ২০২১ ৯:০৮ পূর্বাহ্ন
পোলট্রি উৎপাদনে প্রয়োজন জীবাণুমুক্ত ব্যবস্থাপনা
পোলট্রি

বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-এর ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে সাতটির সঙ্গে পোলট্রিশিল্পের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বিধায় আলাদাভাবে এই শিল্পের গুরুত্ব অনায়াসেই চলে আসে। কারণ বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির উপখাত হিসেবে পোলট্রি খাতের অবদান ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষের স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থান প্রত্যক্ষভাবে এই খাতে রয়েছে। যদি পরোক্ষ অংশটি যোগ করা হয়, তবে এই অঙ্কটি দাঁড়ায় প্রায় ৮০ লাখ।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ বলছে, মানুষের প্রাণিজ আমিষ চাহিদার ৪৫ শতাংশ এখন পোলট্রি খাতনির্ভর এবং এ খাতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা, যেখানে আত্মকর্মসংস্থান তথা উৎপাদন আয় বাড়ানোর অপূর্ব সুযোগ রয়েছে।

পোলট্রিশিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত সংগঠনের নেতারা মনে করেন, দেশে প্রতি বছর গড়ে ১৫ লাখ জনশক্তি শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। আবার শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে এক শতাংশ হারে কমছে আবাদি জমি— যা এক বিস্ময়কর চিত্র। এ পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তা তথা পুষ্টিনিরাপত্তায় এক জ্বলন্ত ভূমিকা রাখতে পারে এই খাতটি।

খাদ্য কৃষি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, মানব দেহের শক্তির ৬০ শতাংশ আসবে শস্যজাতীয় পণ্য থেকে, ১৫ শতাংশ আসবে আমিষজাতীয় খাদ্য থেকে এবং এই আমিষের ২০ শতাংশ হবে প্রাণিজ আমিষ অর্থাৎ মাছ, মাংস ও ডিম থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন একজন মানুষ ৭ গ্রাম ডিম এবং ১৪ গ্রাম মুরগির মাংস খেয়ে থাকে, যা থেকে আমিষ আসে যথাক্রমে এক ও তিন গ্রাম; অথচ এই সংখ্যাটি হওয়ার কথা কমপক্ষে ১৫ গ্রাম। একটি প্রবাদ আছে ‘সুস্থ খাবার সুস্থ জাতি’ এবং এর জন্য প্রয়োজন পোলট্রি উৎপাদনে জীবাণুমুক্ত ব্যবস্থাপনা।

একসময় এই শিল্পটি ছিল আমদানিনির্ভর; কিন্তু বর্তমান বাজারে ক্রমাগত চাহিদার কারণে এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত পোলট্রি খাদ্যের প্রায় ৯৫ শতাংশই আধুনিক ফিড মিলগুলোয় উৎপন্ন হচ্ছে এবং এই খাদ্যে ব্যবহূত ভুট্টার প্রায় ৪০ শতাংশ দেশীয় খামারে উৎপাদিত হচ্ছে। এই পোলট্রিশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের ৪০ শতাংশই নারী, যা নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে।

দেশের আধুনিক হ্যাচারিগুলোতে যান্ত্রিক উপায়ে প্রতি সপ্তাহে এক দশমিক ১০ কোটি ডিম ফোটানো হয় এবং এই শিল্পের বর্জ্য থেকে তৈরি হয় বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ ও সার।

বাংলাদেশে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে মুরগির মাংস প্রক্রিয়াজাত করা হয়, যা ঢাকা শহরের বিভিন্ন পাঁচতারকা হোটলসহ শপিংমলগুলোতে সরবরাহ করা হয়। এ ব্যাপারে দাতা সংস্থা কিংবা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আগামীতে এ খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা এক কোটি জনশক্তির হবে বলে আশা করা যায়।

কারণ এই খাতের ব্যবসা আর পাঁচটি ব্যবসার মতো নয় এবং গ্রামাঞ্চলে অগণিত খামারি সনাতনি কায়দায় খামার পরিচালনা করে থাকেন, যেখান থেকে ডিম কিংবা মাংস সরবরাহ একটি স্পর্শকাতর বিষয়; কিন্তু এই ব্যবসায় উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ অন্যান্য ব্যবসার আদলে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে— যার মধ্যে রয়েছে রোগবালাই, আপদকালীন সময়ের জন্য প্রণোদনা, কর মওকুফ সুবিধা, কাঁচামাল ও পণ্য আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি, নীতি সহায়তার অনুপস্থিতি, অ্যাডভান্স আয়কর, পোলট্রি খাতকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের মর্যাদা না দেয়া, ওষুধের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার, ডিডিজিএসের ওপর থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বলবত, ঋণের ক্ষেত্রে বর্ধিত হারে সুদের হার ইত্যাদি।

বর্তমানে পোলট্রি কৃষির উপখাত হলেও ঋণ নিতে হয় শতকরা ১৬ টাকা হারে; অথচ কৃষি খাতে ঋণের সুদ মাত্র ৫ শতাংশ। একটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিটি পোলট্রি ফার্মের ৬৫ শতাংশ খরচ হয় ফিডে, যার মূল উপাদান ভুট্টা। এর উৎপাদন খরচ কমাতে পারলে অনায়াসেই ডিম-মাংসের দাম কমে আসবে। কারণ ভুট্টার প্রায় ৪০ শতাংশ দেশীয় খামারে উৎপাদিত হয়। দেশে অন্যান্য কৃষিপণ্যের জন্য হিমাগারের ব্যবস্থা রয়েছে, বিশেষত আলু, দুধ, মাছ ইত্যাদি; কিন্তু ডিম কিংবা মাংসের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয় না। সরকার পোলট্রিকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, ফলে প্রতিটি খামারের নিবন্ধন জরুরি— যা প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করবে।

অপুষ্টিতে ভুগছে পোলট্রি খাত : করোনায় দেশের যেসব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর অন্যতম হলো ‘পোলট্রি খাত’। বাংলাদেশ ‘পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল’ (বিপিআইসিসি)-এর হিসাবমতে, জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ফিড ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় ৫২৯ কোটি টাকা এবং সামগ্রিকভাবে পোলট্রিশিল্পে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

আর গত ১২ বছরের মধ্যে পোলট্রির দর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছিল এই দুর্যোগের কারণেই। ২০২০ সালের জুন মাসের সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৩৫-৪০ শতাংশ ফিডের উৎপাদন এবং প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ ওষুধ ও ফার্মাসিউটিক্যালস প্রোডাক্টের বিক্রি কমে গেছে।

বস্তুত পোলট্রি খাতের কয়েক লাখ প্রান্তিক খামারির অবস্থা এখন চরম সমস্যাক্রান্ত। তারা নিপতিত হয়েছেন উভয় সংকটে। একদিকে পোলট্রি খাদ্যের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে কমেছে মুরগি ও ডিমের দাম। গত বছর পোলট্রি ফিডের দাম টনপ্রতি ছিল ৩১ হাজার টাকা, তখন ডিমের দাম ওঠে সাত-আট টাকায়, আর এ বছর পোলট্রি খাদ্যের টন ৪১ হাজার টাকা, অথচ ডিমের দাম কমে নেমে এসেছে চার-পাঁচ টাকায়! লকডাউনে কমেছে মুরগির দাম। এ অবস্থায় দেশের কয়েক লাখ প্রান্তিক খামারি দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।

লকডাউনে পোলট্রি খামারিদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়েছে। উৎপাদন প্রক্রিয়া ও সরবরাহ— দুটিই পড়েছে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। তবে বাস্তবতা হলো, পোলট্রি ফিডের মূল্যবৃদ্ধি একটি বড় সমস্যা। পোলট্রি ফিডের অন্যতম উপকরণ ভুট্টা পোলট্রি ফিড হিসেবে দাম বাড়াটা অযৌক্তিক বটে। করোনায় খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমনিতেই উৎপাদন মূল্য পাচ্ছেন না, তার ওপর পোলট্রি ফিডের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।

পোলট্রি দেশের অন্যতম শিল্প খাত। তাই এ খাতকে শুধু বাঁচিয়ে রাখা নয়, এর শ্রীবৃদ্ধিও ঘটানো উচিত। এ অবস্থায় মৎস্য ও প্রাণিখাদ্য প্রস্তুতকারক ফিড ইন্ডাস্ট্রির স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফিড রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি ২০২৫ সাল নাগাদ পোলট্রি মাংস, ডিম ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের রপ্তানি মার্কেটে প্রবেশের সক্ষমতা অর্জনের জন্য বর্তমান বছরের বাজেটের জন্য তিনটি প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে পোলট্রি-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে।

প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে : সরকারের দেয়া বিদ্যমান সুবিধাগুলো অগ্রিম কর, অগ্রিম আয়কর, কর ও শুল্ক, ভ্যাট ইত্যাদি আরো অন্তত ১০ বছর অর্থাৎ ২০৩০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখা। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, বিশ্বের বড় বড় দেশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অস্থিরতার কারণে রপ্তানিকারক দেশগুলো প্রয়োজনীয় কাঁচামাল রপ্তানির পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছে। বিগত কয়েক মাস যাবৎ মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যে ব্যবহূত কাঁচামালের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া কাঁচামাল পরিবহনে কনটেইনার ও জাহাজ ভাড়াও প্রায় ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আগামী ১০ বছরের জন্য কর অব্যাহতি সুবিধা প্রয়োজন।

এছাড়া উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে ২ থেকে ৫ শতাংশ কর কর্তনের বিধানটি রহিত করার প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া উদ্যোক্তারা পশুখাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট ট্যাক্স ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশের প্রস্তাব করেছে।

কারণ হিসেবে বলা হয়, আগে কর্পোরেট ট্যাক্সের হার ছিল শূন্য শতাংশ। ২০১১ সালে তা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ; ২০১৪-১৫ সালে তা কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে তা আবারও বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। গত বছর করোনা সংকটে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা মূল্যের খামারিদের উৎপাদিত মাছ, মাংস, দুধ ও ডিম ভ্রাম্যমাণ ব্যবস্থায় বিক্রি করা হয়েছিল। এবারও যদি সে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়, তাহলে এ শিল্পের ক্ষতি অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।

অপার সম্ভাবনার পোলট্রিশিল্পে নজর দিন : করোনার অভিঘাত শেষ হলে দেশে প্রাণিসম্পদের মেলা শুরু করতে হবে, যা হবে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। গ্রামাঞ্চলে অগণিত খামারি সনাতনি কায়দায় খামার পরিচালনা করে থাকে, যেখান থেকে ডিম কিংবা মাংস উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ অন্যান্য ব্যবসার আদলে করা যায় না।

কারণ যখন উৎপাদন হয়, তখনই বিক্রি করতে হয়, ফলে অস্থিতিশীল বাজারে উৎপাদকরা পুঁজি হারাচ্ছেন। তাছাড়া চাহিদার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সরবরাহ না থাকা, রোগবালাই, আপদকালীন প্রণোদনা না থাকা, কাঁচামাল ও পণ্য আমদানিতে শুল্ক, আয়কর, পোলট্রি খাতকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের মর্যাদা না দেয়া, ওষুধের ওপর উচ্চ আমদানি শুল্কহার, ঋণের ক্ষেত্রে বর্ধিত হারে সুদহার ইত্যাদিও রয়েছে।

পোলট্রি কৃষির উপখাত হলেও ঋণ নিতে হয় ডাবল ডিজিটে অথচ কৃষি খাতে ঋণের সুদ মাত্র ৫ শতাংশ। বিদেশি কোম্পানির আগ্রাসনও দেশীয় খামারিদের সর্বনাশ করছে। অন্যদিকে কৃষিতে বিদ্যুৎ বিলে প্রণোদনা ও ছাড় থাকলেও পোলট্রি খামারিদের শিল্প খাতের বিল পরিশোধ করতে হয়। ফ্রোজেন মাংস আমদানি করে দেশীয় খামারিদের ক্ষতি করা হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের পোলট্রিশিল্প চলে যাচ্ছে বিদেশি কোম্পানিদের হাতে। এ ব্যাপারে প্রাণী স্বাস্থ্যসেবাকে জরুরি ঘোষণা করা, প্রতি উপজেলায় হাসপাতাল নির্মাণসহ পোলট্রি ভ্যাকসিন-সেবা নিশ্চিতকরণ ও প্রাণিসম্পদ সেবাকে জরুরি সেবার আওতায় এনে এর লোকবল কাঠামো আধুনিকায়ন সময়ের দাবি হিসেবে দেখা দিয়েছে।

লেখক: ড. মিহির কুমার রায়
অধ্যাপক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

 

শেয়ার করুন

প্রকাশ : সেপ্টেম্বর ৮, ২০২১ ৭:১৯ অপরাহ্ন
কৃষিতে বাংলাদেশের নারীদের অবদান
মতামত-ফিচার

জমিলা বিবি, বয়স ৩২; বিয়ে হয়েছিল ঠিক ১৫ বছর বয়সে। ফরিদপুরের পাটচাষী রহিমের সাথে সংসার করছেন ১৭ বছর। এরপর দুই মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে সংসার এগিয়ে গেলেও, সংসারের হাল স্বামীর সাথে ধরতে হয়েছিল তাকেও। দেশে পাটচাষীদের বেহাল দশাতেও তিনি হাল ছাড়েন নি। লড়ে গেছেন শক্ত হাতে। পুব আকাশ ফুরে সূর্য বেরোবার আগেই তার জীবন সংগ্রাম শুরু হয়। দুদিন হলো বোরো ধানের যে জমিটা ছিল, সেটা পরিষ্কার করলো। এরপর দু’বার নিড়ানি দিতে হয়েছে আগাছা পরিষ্কার করার জন্য। ভাগ্যিস মাটিটা যথেষ্ট ভিজে ছিল বিধায় আর নতুন করে সেচের ব্যবস্থা করতে হয়নি। এরপর বীজ বুনলেন, বীজ গজালো। পরম যত্নে জমির পরিচর্যা করলেন।

সার কতটুকু দিতে হবে সে হিসাবটা রহিম মিয়ার থেকে তিনিই ভালো বলতে পারেন। কতটুকু গোবর সার দিলেন সেই থেকে শুরু করে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, সবগুলোর হিসেব তার জানা। সময় নিয়ে আগাছানাশক স্প্রে করলেন। পোকামাকড়ের আক্রমণ হলো কি না সেদিকেও খেয়াল রাখলেন। এরপর এলো পাট কাঁটার পালা। প্রায় চার মাস পর, যখন দেখলেন মাঠের অর্ধেক ফসলে ফুলের কুঁড়ি ধরেছে, তখন বুঝলেন পাট কাঁটার সময় হয়েছে। তড়িঘড়ি করে লোকজন নিয়ে কেঁটে ফেললেন পাট। পাট কাঁটার পর আলাদা করলেন কোনগুলো ছোট ও চিকন এবং কোনগুলো বড় ও মোটা। আলাদা করা হয়ে গেলে আঁটি বেঁদে পাতা ঝরানোর জন্য পাতার অংশ খড়কুটো দিয়ে ৩ দিন ঢেকে রাখলেন যাতে পাতা ঝড়ে যায়। তারপর আঁটিগুলোর গোড়া ৩-৪ দিনের মতো পানিতে ডুবিয়ে রাখলেন জাগ দেয়ার জন্য। এরপরই যেন শুরু হলো মহাযজ্ঞ।

এরপর জাগ তৈরী, জাগ দেয়ার বিশাল এবং পরিশ্রমের পর্ব শেষ করলেন। যখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুঝতে পারলেন যে, পাট যথেষ্ট পঁচানো হয়েছে তখন শুরু করেন আঁশ ছাড়ানো এবং পরিষ্কারপর্ব। দুই পদ্ধতিতে আঁশ পৃথক করা হলেও জমিলা বিবি একটি একটি করে পৃথক করে আঁশ ছড়ান যাতে পাটের গুণগত মান ভালো থাকে। এত পরিশ্রম করার পরও ৩৫০-৪০০ টাকা মজুরিতে যেখানে শ্রমিক রেখে কাজ করাতে হচ্ছে, সেখানে মণে প্রায় ৪০০০ টাকা দাম উঠতেও যেন বাজারের সকলের কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু বীজ কেনা থেকে শুরু করে সেগুলো বপন, চারার পরিচর্যা, কাটা, জাগ দেয়া, আঁশ ছাড়ানো এসবের তো আলাদা খরচ রয়েছেই। তবুও দিনের পর দিন জমিলা বিবি হাসি মুখে টানাটানির সংসার চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই পাটকে অবলম্বন করেই। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য এভাবে তো শেষ হতে দিতে পারেন না!

পুষ্প রাণী, বয়স ২৬। বাড়ির ছোট মেয়ে পুষ্প এখন সংসারের বড় গিন্নি। লেখাপড়ার খুব শখ থাকলেও বাবা মারা যাওয়ায় বিয়ে হয়ে যায়। তবে দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে কোন আপোষ করেননি সে। তাদের নদীর ওপারের বাজারটাতে একটা ছোট দোকান আছে সবজির। এপারের বাজারটাতে সবজির দাম কম আসে বিধায় ওপারের বাজারটাতেই নদী পার হয়ে যান নিজেদের উঠোনের সবজি বিক্রি করতে। লাউয়ের জন্য পুষ্প আলাদা জায়গা করে রেখেছে উঠোনে। লাউ শীতকালীন সবজি হলেও এখন সারাবছর ফলন দিচ্ছে। পুষ্প নিজ হাতে বীজ থেকে চারা করে আশেপাশের বাড়িগুলোতে বিক্রি করেন। উঠোনের যেই কোণাটাতে সবথেকে ভালো আলো-বাতাসের সুবিধা, সেখানে লাউয়ের চারা লাগানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। চারা লাগানোর আগের দিন ভালোভাবে মাটি ভিজিয়ে দেন। জমিটা যেন একটু উঁচু হয়, অন্যান্য জায়গা থেকে সেদিকেও খেয়াল করেন। খুব বেশি সার কিনতে পারবেন না বিধায় গোবর সার আর বাড়ির ফলমূলের সবজি দিয়ে নিজেই সার তৈরি করে।

চারাগুলো একটু ধরতে শুরু করলে সে মাচা বানিয়ে দেয় লতাগুলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। এতে করে ফলন ভালো হবে, গুণগত মান অক্ষুণ্ণ থাকবে। এরপর আগাছা ছাটলো, শোষক শাখা ছেটে দিলো, সময়মতো সার দিলো, দ্রুত ফল আসার জন্য ফুলগুলোর পাপড়ি ছাড়িয়ে পরাগায়ন করে দিল। এরপর আস্তে আস্তে ফুল থেকে ফল এলো, এরপর যখন ফল খাওয়ার উপযোগী হলো, তখন বাজারের জন্য লাউগুলো তৈরি করে দিল। লাউ সব ধরনের আমিষের সাথেই যেহেতু যায়, তাই লাউয়ের চাহিদাও ভালো। আর শীতকালে কচি লাউ দুপুরের আসরে যেন সবার চাই। তবু বাজার পর্যন্ত যেতে যেতে পুষ্পের পরিবার পর্যাপ্ত মূল্য পায় না। বাজারে যেখানে ১০০ থেকে ১২০টাকা করে বিক্রি করতে পারে, সেখানে চাষী পর্যায় থেকে কোন পাইকারি বিক্রেতার হাতে গেলে তিনি যেন দামই ছাড়তে চান না। তাই পুষ্পের পরিবার নিজেরাই নৌকায় করে ওপারের বাজারে গিয়ে লাউ বিক্রি করে। তখন আবার যাওয়া-আসার খরচ, সে যেন আরেক মহাযজ্ঞ! তবুও ধৈর্য্যের সাথে পুষ্প এই কাজকে আঁকড়ে রেখেছে। তার মতে, দু’বেলা তার ক্ষেতের লাউ যদি কারো পাতে জোটে তবে তৃপ্তি করে খেতে পারবে আর তাকে মন ভরে আশীর্বাদও করবে।

৮০ ভাগ সরাসরি কৃষিকাজের সাথে জড়িত পেশাজীবী মানুষের দেশে এমন হাজারো জমিলা বা পুষ্প, আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দেশের মোট কৃষিকাজের সাথে সম্পৃক্ত জনশক্তি মাঝে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী। ৮০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে পারিবারিক কৃষির হাত ধরেই। ধান, গম, ভূট্টা, আলু, প্রভৃতি বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল হলেও প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট এদেশে সব ফসলই জন্মে। দেশীয় সবজি বা ফলফলাদির সাথে প্রযুক্তির মিশেল, দিনকে দিন কৃষিকে নিয়ে যাচ্ছে অনন্য চূড়ায়। তবে খুব সংখ্যক প্রান্তিক চাষীই এসবের সুবিধা পাচ্ছে না। বিশেষ করে, এমন হাজারো নারী যারা কৃষি কাজের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।

অথচ দিনশেষে এই নারীদেরই পোহাতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ভোগান্তি। একজন পুরুষ যেখানে কৃষিকাজে দিনমজুর হিসেবে ৪৫০-৪০০ টাকা পাচ্ছেন, সেখানে একজন নারী পাচ্ছেন মাত্র ৩৫০-২০০ টাকা। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান থাকায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, নারীরা পিছিয়ে আছেন। সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতিতেও তাদের অন্য পেশায় স্থানান্তর করতে হচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায় হতে শুরু করে যদি সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হতে, এদেশের নারীদের পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত সাহায্য এবং কাঁচামাল সরবারহ করা না হয়, তবে দুঃখজনক হলেও মেনে নিতে হবে যে, অচিরেই এই সিংহভাগ কৃষাণী জীবিকার তাগিদে অন্য পেশায় স্থানান্তর করবে।

লেখক: ফামিন জাহান ঐশী
শিক্ষার্থী
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন

প্রকাশ : সেপ্টেম্বর ৭, ২০২১ ১১:২১ পূর্বাহ্ন
‘মাছ হবে বৈদেশিক আয়ের দ্বিতীয় প্রধান উৎস’
মতামত-ফিচার

বিগত ২৮ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পালিত হলো ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২১’। এবারের জাতীয় মৎস্য সপ্তাহের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘বেশি বেশি মাছ চাষ করি, বেকারত্ব দূর করি’। মৎস্য চাষের সঙ্গে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন ও বেকারত্ব দূরীকরণের বিষয়টি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত। বাঙালির সংস্কৃতি ও জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে মাছ। দেশের সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের পুষ্টিচাহিদা পূরণ, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন ও রপ্তানি আয়ে মৎস্য খাতের অবদান অনস্বীকার্য। মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৩.৫২ শতাংশ, কৃষিজ জিডিপিতে ২৬.৩৭ শতাংশ এবং মোট রপ্তানি আয়ের ১.৩৯ শতাংশ মৎস্য খাতের অবদান। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ ভাগ আসে মাছ থেকে। দেশের প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় দুই কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের বিভিন্ন কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে জনপ্রতি প্রতিদিন ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে ৬২.৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহণ করছে।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ঘোষণা করেছিলেন, ‘মাছ হবে দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ’। মৎস্য খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে মুজিববর্ষ উপলক্ষে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নেত্রকোনা জেলার ‘দক্ষিণ বিশিউড়া’ ও শরীয়তপুর জেলার ‘হালইসার’কে ‘মৎস্য গ্রাম’ ঘোষণা করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মাছ নিয়ে তাদের ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২০’ শিরোনামে প্রকাশিত বৈশি^ক প্রতিবেদনে বলেছে, স্বাদু পানির উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশে^ তৃতীয়। দেশে উৎপাদিত মাছের ৭৫ শতাংশ এখন বাজারজাত করছেন মৎস্যচাষিরা। এ ছাড়া কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ৩০ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছ। দেশীয় মাছ সংরক্ষণে ময়মনসিংহে ‘লাইভজিন’ ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। ফলে দেশীয় মাছ আবার ফিরে এসেছে ভোজনরসিক বাঙালির পাতে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উন্মুক্ত করা হয়েছে নতুন উদ্ভাবিত চতুর্থ প্রজন্মের অধিক উৎপাদনশীল ও দ্রুত বর্ধনশীল ‘সুবর্ণ রুই’। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। বাংলাদেশের ইলিশ ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন’ বা ‘জিআই’ সনদ পেয়ে নিজস্ব পরিচয়ে বিশ^বাজারে স্বমহিমায় হাজির হয়েছে। ইলিশ সম্পদ রক্ষা ও ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে সরকার নানামুখী সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ফলে ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান, মানুষের পুষ্টিচাহিদা পূরণে মাছের গুরুত্ব, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও মাছ চাষে আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন ও দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে জনগণকে আরও সম্পৃক্ত ও সচেতন করা হচ্ছে।

এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে মাছের উৎপাদন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয় ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪১ লাখ ৩৫ হাজার টন এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৬ লাখ ৮১ হাজার টন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৫ লাখ ৫২ হাজার টনে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয় ৪৫.০৩ টন। বাংলাদেশ বিশে^ ইলিশ আহরণে প্রথম, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে পঞ্চম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ। এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে সরকারের মৎস্যবান্ধব নীতি ও সহায়তা, মৎস্য বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং মৎস্যচাষিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। সরকারের ‘জাটকা নিধন’ ও ‘মা ইলিশ আহরণ’ বন্ধে গৃহীত পদক্ষেপের ফলে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যে ইলিশ উৎপাদন ছিল ২.৯৯ লাখ টন তা বেড়ে ২০১৯-২০ সালে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার টনে। ইলিশ সম্পদ রক্ষায় ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ লাখ ২ হাজার ৩৩৮টি জেলে পরিবারকে মোট ৬৬ হাজার ৭৯১ টন ভিজিএফ চাল দেওয়া হয়েছে। জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ৩ কোটি কোটি ৫০ লাখ টাকার ‘ইলিশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন তহবিল’ গঠন করা হয়েছে। বৈশি^ক মহামারী কভিড-১৯ মোকাবিলায় উপকূলীয় ৭৭ হাজার ৮২৬ জন প্রান্তিক এবং মাঝারি খামারিকে ৯৯ কোটি ৭০ লাখ ২৭ হাজার টাকা নগদ সহায়তা প্রদান ও ৬ হাজার ৪৩৮ জন মৎস্যচাষিকে স্বল্পসুদে মোট ১৫৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এই করোনাকালে অনলাইন বিক্রয় কেন্দ্র, ভ্রাম্যমাণ মাছ বিক্রয় কেন্দ্র/গ্রোথ সেন্টারের মাধ্যমে মোট ৮৩০ কোটি ৩০ লাখ ২৬ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করা হয়েছে। মৎস্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বাংলাদেশে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, রাশিয়া, চীনসহ বিশে^র ৫০টিরও বেশি দেশে ২০০২-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭৬ হাজার ৫৯২ টন মাছ রপ্তানি করে, যার মূল্য ৪ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, ও খুলনায় ৩টি বিশ^মানের মাননিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগার স্থাপন করা হয়েছে এবং প্রণয়ন করা হয়েছে মৎস্য ও মৎস্যপণ্য (পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০২০।

কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত ২০০৮ সালে মৎস্য উপ-খাতে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫.০০ শতাংশ। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ২০১৫ সালের মধ্যে অর্জিত নির্দিষ্ট আটটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ সরকার প্রণীত দারিদ্র্যবিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্যবান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য উপ-খাতকে অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

দারিদ্র্যবিমোচনে মৎস্য উপ-খাতের বিশেষ করে মাছ চাষ সম্প্রারণ ও মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য সম্পদের জৈবিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দারিদ্র্যবান্ধব অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। দেশে বেকারের সংখ্যা ২০২১ সালের মধ্যে ১.৫ কোটিতে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বর্তমান দারিদ্র্যসীমাকে ২০ শতাংশ ও চরম দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জনে মৎস্য উপ-খাত বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। স্বল্পপুঁজি বিনিয়োগ ও আধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে দারিদ্র্যবিমোচনে মৎস্য চাষ সূচনা করতে পারে এক সম্ভাবনাময় সোনালি অধ্যায়।

লক্ষ করা প্রয়োজন, মৎস্য চাষের মধ্য দিয়ে দারিদ্র্যদূরীকরণ এবং রপ্তানি আয়ের উপরোক্ত পুরো আলোচনাটিই মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদ-সংক্রান্ত। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ২০০ নটিক্যাল মাইলের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের মৎস্য সম্পদের আলোচনা এখানে নেই। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, পৃথিবীর সব মানুষের মোট আমিষ চাহিদার শতকরা ১৫ ভাগ আসে সামুদ্রিক সম্পদ থেকে। সম্প্রতি সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরের মৎস্য সম্পদকে কাজে লাগানোর বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশেষজ্ঞদের মতে শামুক, সেল-ফিশ, কাঁকড়া, হাঙর, অক্টোপাস এবং অন্যান্য প্রাণী ছাড়াও শুধু মাছেরই ৫০০ প্রজাতি বিদ্যমান বঙ্গোপসাগরে। ধারণা করা হয়, প্রতি বছর বাংলাদেশে বঙ্গোপসাগরের সহজলভ্য মোট ৮ মিলিয়ন টন মাছের মধ্যে আহরণ করা হয় মাত্র ০.৭০ মিলিয়ন টন মাছ। অন্যদিকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সুনীল অর্থনীতির ২৬টি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে মৎস্য সম্পদ আহরণ অন্যতম। এই পরিস্থিতিতে দেশের অভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদের সঙ্গে বঙ্গোপসাগরের মৎস্য সম্পদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে, সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে জাতির জনক মৎস্য সম্পদের বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ হয়ে ওঠার যে সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন, সেটা সত্যে পরিণত হতে পারে।

লেখক কৃষিবিদ ও সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন
[email protected]
সূত্র: দেশ রুপান্তর

শেয়ার করুন

প্রকাশ : অগাস্ট ২৫, ২০২১ ২:০০ পূর্বাহ্ন
অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং বেকারত্ব হ্রাসে কৃষি ফার্ম
কৃষি বিভাগ

বর্তমান সময়ে কৃষকের ছেলে কৃষক হবে এমন কথা একেবারেই ভিত্তিহীন। কিন্তু কৃষির ওপর ভিত্তি করে আজও আমরা আমাদের সুখ-দুঃখের হিসাব-নিকাশ করে থাকি। দেশের কৃষির উৎপাদন কমে গেলে সারাদেশের মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। সমস্যাটি যেন শুধু কৃষকদের থাকে না, সবার মাঝেই ছড়িয়ে পড়ে। কৃষি দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ ভাগ এবং শ্রমশক্তির ৫৫ ভাগ কোন না কোনভাবে কৃষিতে নিয়োজিত।

বর্তমানে দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের মধ্যে পোল্ট্রি ফার্ম, ডেইরি ফার্ম, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, মৎস্য উৎপাদন, হিমায়িতকরণ শিল্প রয়েছে। এসব শিল্পে বেশকিছু বড় বড় কোম্পানি বিনিয়োগ করছে।

বর্তমানে দেশে বেশ কিছু খ্যাতিসম্পন্ন কোম্পানি যেমন আকিজ, স্কয়ার, এসিআই কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ করছে এবং দৈনন্দিন জীবনের চাহিদামাফিক বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্য বাজারজাত করছে। অনেক কোম্পানি কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে কৃষকদের নিকট থেকে সরাসরি কৃষি পণ্য সংগ্রহ করছে। তবে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের মূল কাঁচামাল কৃষি ফসল উৎপাদনে সরাসরি বড় প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায় না। ব্যক্তি ও পারিবারিক উদ্যোগে কিছু ফলমূল ও সবজি উৎপাদন এলাকা গড়ে উঠলেও বৃহৎ পরিসরে গড়ে উঠেনি কোন সুপরিকল্পিত কৃষি ফসল উৎপাদনমুখী ফার্ম। ফলে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের কৃষক এবং বর্গাচাষীরাই ভরসা যাদের উৎপাদনের হার কম।

দেশে কৃষি উৎপাদন ফার্ম গড়ে উঠলে পরিকল্পিতভাবে মাটির গুণাগুণ অনুসারে খণ্ড খণ্ড জমিগুলো এক করে ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে এবং উৎপাদন আরও বৃদ্ধি হবে। পাশাপাশি কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণও অনেকাংশে সহজ হবে।

দেশের দক্ষিণাঞ্চল খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এলাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমি লিজ নিয়ে বেশ কিছু মৎস্য খামার গড়ে উঠেছে। অন্যান্য এলাকায়ও এরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করে কৃষি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। একই এলাকার আশেপাশের খণ্ড খণ্ড জমির মালিকদের নিয়ে কৃষি পণ্য উৎপাদনমুখী সমবায় সমিতি গঠন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের কৃষি ফার্ম গঠন করে সমন্বিত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যেতে পারে।

জমির মালিকদের নিকট থেকে বছরভিত্তিক লিজ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত কোনো সমবায় সমিতির মাধ্যমেও কৃষি ফার্ম গঠন করা যায়। নতুন নতুন এনজিও এবং কোম্পানি প্রতিষ্ঠাপূর্বক তাদের মাধ্যমে কৃষি ফার্মভিত্তিক চাষাবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করলে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অনেক সহজ হবে।

গ্রামীণ জনগোষ্ঠী জমি লিজ হতে প্রাপ্ত অর্থের পাশাপাশি এসব ফার্মে কাজ করে অর্থ উপার্জনও করতে পারবে। ফার্মের কাজের বাইরে বাকি সময়ে নিজের কাজ করলে অর্থনীতিতে ছদ্মবেশী বেকারের হারও হ্রাস পাবে। কৃষি ফার্মে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ গ্রহণের পাশাপাশি বৃহৎ ফার্মে বা কয়েকটি ছোট ছোট ফার্মকেন্দ্রিক একজন করে কৃষিবিদ নিয়োগ করলে ফার্মভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা কৃষিখাতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিবে। ফলে কৃষি কাজের সামাজিক মর্যাদাও বাড়বে এবং শিক্ষিত বেকার শ্রেণীকে চাকুরি হিসেবে কৃষিখাতে নিযুক্ত করা সম্ভব হবে। কারণ একজন শিক্ষিত বেকার মাঠে চাষাবাদের বদলে একই কাজ প্রতিষ্ঠিত কৃষি ফার্মে করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে।

ফার্মে জনসাধারণের কর্মসংস্থানের ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতি সাধন হবে এবং নগরায়ন সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক কৃষি ঋণ বিতরণের পাশাপাশি এসব ফার্মে ঋণ প্রদানপূর্বক কার্যকর কৃষি ঋণের পরিমাণও অনেকগুণ বাড়াতে পারবে।

আমাদের পাশের দেশগুলোতে কৃষি ফার্ম গড়ে উঠছে। আমাদের দেশের জমির মালিক পক্ষ, ফার্ম পরিচালনাকারী কোম্পানি বা এনজিও, প্রশাসন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সমন্বয় করে কৃষি ফার্ম গঠন কিছুটা কষ্টসাধ্য হলেও উদ্যোগ গ্রহণ করলে সেটা অবশ্যই সম্ভব। এরূপ কয়েকটি ফার্ম প্রতিষ্ঠিত হয়ে লাভের মুখ দেখলে বড় এবং মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠান কৃষি ফার্মভিত্তিক বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। এর ফলে, সমন্বিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বেকারত্ব হ্রাসেও কৃষি ফার্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

লেখক: রিয়াজুল হক
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

শেয়ার করুন

প্রকাশ : অগাস্ট ১০, ২০২১ ২:২৮ অপরাহ্ন
জাতীয় স্বার্থে জরুরী ভিত্তিতে বাংলাদেশে ভেনামী চাষ উন্মুক্ত করা প্রয়োজন
মতামত-ফিচার

জানতে পারলাম মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিউটের দু‘একজন গবেষক এখনো দেশে ভেনামী চিংড়ি চাষের বিরোধিতা করছে। তাদের সাথে এ বিষয়ে একটা কনফারেন্স করতে চাই। জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার নিকট বিজ্ঞান পরাস্ত হলে দেশে উন্নয়ন হয় না।

চিংড়ি হ্যাচারি ও চাষ সেক্টরে দেশ-বিদেশে ৪০ বছর চিংড়ি বিষয়ে কাজের অভিজ্ঞতা ও প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে জানতে পারি, ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে ১.৬ মিলিয়ন এস.পি.এফ লি. ভেনামী চিংড়ির ব্রুড বিপণন হয়েছে। এ ব্রুডের বাজার মুল্য ছিল ৮৯ মিলিয়ন ডলার। ১.৬ মিলিয়ন ব্রুডের প্রধান ক্রেতা ছিল চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণের ক্রেতা ছিল মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা ও তাইওয়ান।

তাছাড়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকাও এস. পি. এফ ব্রুড ক্রয় করেছে। ১.৬ মিলিয়ন ব্রুডের অতিরিক্ত ০.২৪ মিলিয়ন ব্রুড ভারতসহ কতিপয় দেশ নিজ দেশে উৎপাদন করেছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ও মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় দেশে এস.পি.এফ. ব্রুড চিংড়ির ব্রুড উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ভারতে ভেনামী চিংড়ির হ্যাচারি ও পোনা উৎপাদন:
২০১৯ সালে ভারত হাওয়াই থেকে ২,৩৩, ৪২৫ টি এস. পি এফ. লি. ভেনামী চিংড়ির ব্রুড আমদানি করেছে। ২০১৮ সালে ভারত ২,৫৪,২৭০ টি ব্রুড আমদানি করেছিল।

মুহুর্তে ভারতের ১৪৯ টি হ্যাচারি এস.পি.এফ ভেনামী চিংড়ির ব্রুড আমদানি করছে। আগস্ট-২০ এ তারা ২৩,৪৯০ টি ব্রুড আমদানি করে। ভারতের বর্তমান বাৎসরিক এস.পি.এফ ব্রুড স্টকের চাহিদা ২,৬০,০০ এবং এ চাহিদা আগামী ২/৩ বছরে ৪,৫০,০০০ উন্নীত হবে ধারণা করা হচ্ছে।

২০১৯ সালে ভারতের ৩১১ টি হ্যাচারি এস. পি. এফ. ব্রুড আমদানির জন্য নিবন্ধিত ছিল। তন্মধ্যে, ১৪০ টি হ্যাচারি ব্রুড আমদানি করে এস.পি.এফ.পোনা উৎপাদন করে। ভারতের “ভাইসাকি কোম্পানি” সর্বাধিক ১৫ হাজার ব্রুড আমদানি করে এবং “বি.এম.আর.গ্রুপ” আমদানি করে ১৩ হাজার। বি.এম.আর. গ্রুপ নিজস্ব বি.এম.সিতে ২০১৯ সালে প্রায় ২৫ হাজার ব্রুড উৎপাদন করে। বি.এম.আর. গ্রুপের বাৎসরিক ৮০ হাজার ব্রুড উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে। বি.এম.আর. গ্রুপ আগামীতে ভারতের বিভিন্ন হ্যাচারিতে এস.পি. এফ ব্রুডের মুখ্য সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে ভারতের আমদানি নির্ভরশীলতা অনেক কমে যাবে।

ভারতের “সপ্তগিরি গ্রুপ” ২০১৯ সালে ১০ হাজারের অধিক এস.পি.এফ ব্রুড আমদানি করেছে। সিপি, ভারত ২০১৯ সালে মোট ৮,৮০০ এস.পি. এফ ব্রুড নিজস্ব হ্যাচারিতে ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ৩,২০০ আমদানি করেছে এবং ৫,৬০০ রাজীব গান্ধী সেন্টার ফর এ্যাকুয়াকালচার (RGCA),চেন্নাই থেকে ক্রয় করেছে।

ভারতে ২০১৯ সালে ৮,০৪,০০০ টন চিংড়ি উৎপাদিত হয়েছে। আগামী ২/৩ বছরের মধ্যে ভারত ১০ লক্ষ টন চিংড়ি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করছে। বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানি ৩০- ৪০ হাজার টনে সীমাবদ্ধ।

বাংলাদেশে ভেনামী চিংড়ির পোনা উৎপাদন ও চাষ:
এশিয়ায় ভেনামী চিংড়ি চাষ আরম্ভের ২২ বছর পর ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে ভেনামী চিংড়ির পরীক্ষামূলক চাষ আরম্ভ হয়। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক ফলাফল সন্তোষজনক। তাই এ মূহুর্তে মিটিং-সিটিংয়ের মাধ্যমে সময় নষ্ট না করে অনতিবিলম্বে চাষিদের ভেনামী চিংড়ি চাষ আরম্ভে করার বিষয়টি উন্মুক্ত করে দেয়া দরকার। সাথে সাথে অবকাঠামো ও এস.পি.এফ বিষয়ে সক্ষমতা থাকা আগ্রহী হ্যাচারি কতৃক এস.পি.এফ. ব্রুড আমদানি করে পোনা উৎপাদনের অনুমতি দিতে হবে। বহু আগ্রহী উদ্যোক্তা ভেনামী চিংড়ি চাষ করতে আগ্রহী।

বহু মানুষ চাষের অনুমোদনের জন্য আবেদন করলেও আবেদন কর্তৃপক্ষের ফাইলে বন্দী আছে। চাষের অনুমোদন ও পোনার দুষ্প্রাপ্যতা চাষ আরম্ভ করার প্রধান অন্তরায়। হ্যাচারিতে উৎপাদন আরম্ভ না হওয়া পর্যন্ত সময়ে এস.পি.এফ পোনা আমদানির সহজ সুযোগ করে দিতে হবে। পোনা ও ব্রুড আমদানির সহজ ও হয়রানি মুক্ত করার জন্য স্থানীয় জেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে আমদানি অনুমোদনের ক্ষমতা দিতে হবে।

জানতে পারলাম মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিউটের দূএকজন গবেষক এখনো দেশে ভেনামী চিংড়ি চাষের বিরোধিতা করছে। তাদের সাথে এ বিষয়ে একটা কনফারেন্স করতে চাই। অজ্ঞানীর নিকট বিজ্ঞান পরাস্ত হলে দেশে উন্নয়ন হয় না।

বাংলাদেশে এ্যাকুয়েটিক কোয়ারেনটাইন কেন্দ্র স্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত রপ্তানিকারক দেশের স্বীকৃত ল্যাবের জীবানু বিষয়ক সনদের মাধ্যমেই এস. পি.এফ পোনা ও ব্রুড আমাদানি করার অনুমোদন দিতে হবে।

বাংলাদেশে এস. পি.এফ পোনা উৎপাদনের সঠিকতা পর্যবেক্ষণ, তদারকি এবং এস. পি. এফ হ্যাচারি সম্প্রসারণ, এ্যাকুয়েটিক কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্র স্থাপন, প্যাথোলজিক্যাল ল্যাব স্থাপন, পিউর ফাইটোপ্লাংটন চাষের ইনডোর ল্যাব স্থাপন, এস.পি.এফ জীবিত খাদ্য উৎপাদন ইত্যাদি বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তর কতৃক জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।

উন্নত পদ্ধতি এবং অর্ধ নিবিড় ও নিবিড় পদ্ধতির চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত চাষ না হলে এস. পি. এফ পোনার চাহিদা সৃষ্টি হবে না এবং উৎপাদনও বাড়বে না। তাই, উন্নত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের জন্য সম্প্রসারণ কাজ এবং চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতেই হবে।

এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চিংড়ি উৎপাদন বাড়ছে; আর বাংলাদেশে তা প্রতি বছর কমছে। লজ্জার বিষয় হল বিরূপ পরিবেশের মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় দেশ বাংলাদেশ থেকে অধিক চিংড়ি উৎপাদন করছে।

লেখক:এম কবির আহমেদ
কনসালটেন্ট, হালদা ফিশারিজ লিঃ
শেয়ার করুন

বিজ্ঞাপন

ads

বিজ্ঞাপন

ads

বিজ্ঞাপন

ads

বিজ্ঞাপন

ads

বিজ্ঞাপন

ads

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

ads

ফেসবুকে আমাদের দেখুন

ads

মুক্তমঞ্চ

scrolltop