৬ বছরে পোল্ট্রি ফিডের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০ শতাংশ, দায় কার ?
পোলট্রি
আবারো বাড়লো পোল্ট্রি ফিডের দাম যা স্মরণকালের সর্বোচ্চ । গত ৬ বছরের মূল্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বস্তাপ্রতি এই মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ । কিন্তু সেই অনুপাতে মুরগির দাম বাড়েনি, ফলের খামারিদের অবস্থা দিনকে দিন হয়েছে শোচনীয় । ব্রয়লার মুরগির খাবারের দামের অস্থিতিশীলতা গত কয়েক বছরে চরম আকার ধারন করেছে । সাধারনত এদেশের খামারীগন ব্রয়লার পালনের ক্ষেত্রে রেডি ফিড খাওয়ান এবং দেশে অসংখ্য ফিড কোম্পানি রয়েছে । বিগত বছরগুলির ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে, ২০১৬ সালে প্রতি ৫০ কেজি ফিডের বস্তার দাম ছিল কোম্পানিভেদে ২০৫০-২১০০ টাকা । সময়ের সাথে সাথে ফিডের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু চরম রূপ ধারন করেছে মূলত ২০১৯ এর আগস্ট থেকে । সেই সময়ে ফিডের দাম কোম্পানিভেদে বস্তাপ্রতি ২২৫০ থেকে ২৩০০ টাকা ছিল, ২০২০ এর প্রায় পুরোটা সময় এই দাম ২৪০০ থেকে ২৪৫০ টাকার মাঝে ছিল আর সেটা বৃদ্ধি পেতে পেতে ২০২১ সালের জুলাই মাসে হয় প্রায় ২৫০০-২৫৫০ টাকা । এরপর কয়েক দফা মূল্য বৃদ্ধি পায়, সর্বশেষ মূল্য বৃদ্ধির পর (২০২২ এর ১১ মার্চ) বস্তাপ্রতি ব্রয়লার ফিডের মূল্য হয়েছে কোম্পানিভেদে প্রায় ২৯২০-৩০০০ টাকা । অর্থাৎ ৬ বছরে ফিডের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বস্তাপ্রতি ১০০০ টাকা (২০১৬ তে ২০৫০-২১০০ থেকে মার্চ, ২০২২ এ ৩০০০ টাকা), কেজিতে প্রায় ২০ টাকা । ফলে মুরগির উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে অনেক, কিন্তু এই দাম বৃদ্ধির পেছনে দায় কার ? এক কথায় উত্তর দিলে সহজেই এই দায় চাপিয়ে দেওয়া যায় ফিড মিল মালিকদের উপর, কিন্তু আসলেই কি তাই ?
২০২০ সালের নভেম্বর মাসে আমাদের ফেসবুক পেইজে পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনে যেসব কাঁচামাল প্রয়োজন তার মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটির আইটেমের প্রতিদিনের মূল্য নিয়ে ধারাবাহিক পোস্ট করতাম । ১৩ নভেম্বর, ২০২০ এ আমাদের দেওয়া কয়েকটি আইটেমের মূল্য এবং ১৬ মাসের ব্যবধানে সেই আইটেমগুলোর বর্তমান বাজার মূল্য নিম্নরূপঃ
এই তথ্যগুলি দেখার পর যারা ফিড মিলগুলিকে দায় দিচ্ছিলেন তাঁরা হয়ত বুঝতে পারবেন যে তাদের দায় দেয়াটা কতটা যৌক্তিক ।
পোল্ট্রি ফিডের মূল্য বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানান এনাম ট্রেডিং এর এজিএম মোঃ সাইফুল আলম। তিনি বলেন, দেশের অন্য সকল সেক্টর এর মতো পোল্ট্রি খাত আমদানী নির্ভর, ফিড তৈরীর কাচামাল এবং মেডিসিন বেশীর ভাগই আমদানী নির্ভর, পোল্ট্রি খাদ্যের মুল উপাদান ভুট্রা, সয়াবিন মিল, রেপসীড কেক, ডিওআরবি, লাইমষ্টোন এবং বিভিন্ন প্রোটিন যেমন পোল্ট্রি মিল, ফিশমিল, সিজিএম এসব পন্যের মধ্যে অল্প পরিমানে ফুলফ্যাট সয়াবিন আমাদের দেশে চাষ হলে এটা অত্যন্ত নগন্য পরিমান । আর ফিড তৈরীর মুল উপাদান ভুট্রার ব্যাপক চাষ হলেও আমাদের চাহিদা পুরনের জন্য সারা বছর নির্ভর করতে হয় ভারত, ব্রাজিল কিংবা ইউরোপীয় দেশ গুলির উপর। । সারা বছরই দফায় দফায় ভুট্রা সয়াবিনের মুল্যবৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অন্য সকল কাঁচামালের দাম – ৪০ টাকা দামের ডিসিপি এখন ৭৫ টাকা, ৮ টাকা দামের লাইমষ্টোন এখন ১৩-১৪ টাকা, ২৪০ টাকার ডি এল মিথুনিন ৩১০ টাকা, ১৪৫ টাকার লাইসিন ২২০ টাকা, ২০ টাকার রাইচ পলিশ এখন ৩০ টাকারও বেশী । এই সময়ে নতুন ভুট্রার দাম যেখানে প্রতি বছর ১৬ -১৮ টাকায় মৌসুম শুরু হয় সেখানে এ মৌসুমে শুরুই হয়েছে ৩০ টাকার উপর, মৌসুমের শেষ পর্যন্ত এটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা অনুমান করাও দুঃসাধ্য । সয়াবিন এর বাজার পুরোটাই অস্হিরতা আর অনিশ্চয়তায় ছিলো সারা বছর । দফায় দফায় মুল্য বৃদ্ধি আর বিকল্প হিসাবে আগে মিট এন্ড বোন মিল ব্যবহার করলেও এখন সেটি নিষিদ্ধ থাকায় সয়াবিন এর বিকল্প কিছু নেই বলে সয়াবিন এর বাজার নির্ভর করে দেশের বড় দুই জায়ান্ট সিটি আর মেঘনার ইচ্ছে অনিচ্ছের উপর আর আন্তর্জাতিক বাজারে মুল্য বৃদ্দির নতুন অনুঘটক রাশিয়া ইউক্রেম যুদ্ধের কারনে এ অস্থিরতা আরো বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে বিটিসি লিমিটেড (ফিড ইনগ্রেডিয়েন্টস অ্যান্ড এডিটিভস সাপ্লাই ডিভিশন) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলতাফ বিশ্বাস বলেন, আমদানি নির্ভরতা, আমদানিকৃত পণ্য পরিবহণ ভাড়া বৃদ্ধি, কনটেইনারের স্বল্পতা, যুদ্ধ ও বৈশ্বিক মহামারি – এসব কারণগুলোও বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী । তিনি আরোও বলেন – আমাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গার্মেন্টস পণ্যের রপ্তানি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সুস্থ্য, সবল ও মেধাবী জাতি গঠনের জন্য বেশি বেশি আমিষের যোগান বৃদ্ধিও গুরুত্বপূর্ণ । কিন্তু বর্তমানে যে অবস্থা তাতে প্রোটিনের সংকট দেখা যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, অথচ বৈশ্বিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে চীন তাদের আগামী ২ বছরের কাঁচামাল মজুদ করে রেখেছে, আমাদের মত দেশগুলি পিছিয়ে পড়েছি, তার স্বরূপ আজকের এই সংকট ।
বর্তমানে দেশের পোল্ট্রি সেক্টরের অবস্থা এতটাই শোচনীয়, শুধু যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের খামার বন্ধ হয়েছে তা নয়, ইতোমধ্যে ছোট ছোট অনেক ফিড মিল বন্ধ হয়েছে, আর যারা টিকে আছে তারাও রয়েছে অস্তিত্ব সংকটে । বর্তমানে এমন একটা অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে ফিড কোম্পানিগুলোর ফিড বিক্রি করলেই বরং লস হচ্ছে । আগামীতে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি আর পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলে আবারো ফিডের মূল্য বৃদ্ধি পাবে । ততদিনে ফিড মিল মালিকদের উপর দায় দেবার মত খামারি খুঁজে পেতে কষ্ট হবে, এই সময়ে হয়ত আরোও অনেক ফিড মিল হারিয়ে যাবে আর ডিম ও মাংসের মূল্য কোথায় যাবে তা সময়ই বলে দেবে…
ডাঃ খালিদ হোসাইন
সম্পাদক
৫ বছরে খাদ্যের বস্তার দাম বেড়েছে প্রায় ৫০০ টাকা, ব্রয়লারের দাম বেড়েছে কত ?