কোরবানির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে চামড়াশিল্প
মতামত-ফিচার
।।শাইখ সিরাজ।। বাংলাদেশের অর্থনীতি আগের তুলনায় সমৃদ্ধ হলেও বহু সাধারণ মানুষ এখনো দিন আনে দিন খায়। দীর্ঘ লকডাউন এ মানুষকে সীমাহীন কষ্টে ফেলে দিয়েছে এটা যেমন সত্য, তেমনি সংক্রমণ রোধে লকডাউন দেওয়ার বিকল্পও কিছু ছিল না। যেভাবে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়ছে তা সত্যিকার অর্থেই ভয়জাগানিয়া। এদিকে এগিয়ে আসছে ঈদুল আজহা। এ ঈদ ঘিরে বাংলাদেশের বহু খামারি স্বপ্ন বুনেছেন। দ্বিতীয়বারের মতো আমরা করোনার মাঝে কোরবানি ঈদ পাচ্ছি। গত কোরবানি ছিল একেবারেই ভিন্নরকম।
করোনার ভিতর ঈদের আনন্দের চেয়ে শঙ্কা ছিল বেশি। কোরবানির সঙ্গে কৃষি অর্থনীতির পাশাপাশি যুক্ত রয়েছে চামড়াশিল্পও। কিন্তু দেশে করোনা পরিস্থিতি যেভাবে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছিল সেখানে যে কোনো গণজমায়েতই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। যেখানে করোনা পরিস্থিতির কারণে হজ ও মসজিদে নামাজের ক্ষেত্রেও নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সেখানে এ পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে কোরবানির বাজার নিয়ে আগে থেকেই পরিকল্পিত প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
গত বছর সরকার-সংশ্লিষ্টরা যখন ঘোষণা করলেন স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে বরাবরের মতোই কোরবানির পশুর হাট বসানো হবে, তখন আমি করোনার সার্বিক পরিস্থিতি উল্লেখ করে তাঁদের বিকল্প পথ খোঁজার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। চ্যানেল আইয়ের নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘টু দ্য পয়েন্ট’-এর এক আলোচনায় বলেছিলাম কোরবানির পশুর অনলাইন বাজারব্যবস্থা শক্তিশালী ও কার্যকরের জন্য। প্রতিটি ইউনিয়নেই ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। সরকার চাইলে এ জনশক্তি ব্যবহার করে সহজেই কোরবানির পশুর অনলাইন মার্কেট চালু করতে পারে।
এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম আইসিটি-বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। তাঁরা তখন বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। সে বছর অনলাইন কোরবানির বাজার বেশ গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা রেখেছিল। এ বছরও তাই হচ্ছে। অনলাইনই হয়ে উঠছে কেনাবেচার দারুণ মাধ্যম।
দিনে দিনে পাল্টেছে বাজারের ধারণা। সেই সঙ্গে পাল্টেছে গরু বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়াও। কোরবানি সামনে রেখে প্রতি বছরই ছোট বড় অসংখ্য গরুর খামার গড়ে উঠছে। খামার বাড়ছে। পরিবর্তন এসেছে ভোক্তা ও খামারির ভাবনায়ও। ভোক্তা ও ক্রেতার মধ্যে গরুর মান সম্পর্কে ইতিবাচক সচেতনতা তৈরি হয়েছে।
এখন স্টেরয়েড বা ক্ষতিকর রাসায়নিক খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণের ব্যাপারটি খুব বেশি নেই। শিক্ষিত মানুষের খামার উদ্যোগে যুক্ত হওয়া, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও গণমাধ্যমের তুমুল তৎপরতায় খামারি, ভোক্তা, ব্যবসায়ী সবাই গরু মোটাতাজাকরণের ইতিবাচক ধারণাটি পেয়ে গেছেন।
অথচ কয়েক বছর আগেও দেখেছি শুধু টাকার লোভে অসাধু পন্থা অবলম্বন করতে গিয়ে বহু খামারি ও ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এখন স্টেরয়েড খাওয়ানো গরুর স্বভাব দেখে সব ক্রেতাই চিনতে পারেন। এজন্য খামারিরাও অধিক সতর্ক হয়ে উঠেছেন। গত কয়েক বছরে দেখেছি কোরবানির সময় রাসায়নিক প্রয়োগের সন্দেহে যেসব গরু বিক্রি হয়নি সেগুলোর মধ্যে অনেক গরুই হাটেই মারা গেছে। কারণ রাসায়নিক প্রয়োগের কারণে গরুর শরীরে যে বাড়তি পানি জমে তা একটি নির্দিষ্ট সময় পরে বিষক্রিয়া করে। যা গরুর বেঁচে থাকার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
বিষয়গুলো এখন সচেতন খামারিদের কাছে পরিষ্কার। তারা বেশি বিনিয়োগ করে খামার গড়ছেন তাদের কাছে বিষয়টি বেশি চ্যালেঞ্জিং। তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন বিশুদ্ধ খাদ্য দিয়ে গরু মোটাতাজা করতে।
টেলিভিশন প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে এমনই কয়েকজন উদ্যোক্তার দেখা পেলাম গত কয়েক দিনে। যেমন ঢাকার অভিজাত এলাকার মানুষের চাহিদা বিবেচনায় প্রকৌশলী মকবুল হোসেন গড়েছেন গরুর খামার। তিনি শুরু করেছিলেন গাভি পালন দিয়ে। পরে যুক্ত করেন বিশুদ্ধ উপায়ে দেশি পদ্ধতিতে মাংসের গরু পালন। বললেন, অনলাইনেই বেচা হয়ে যায় সব। লাইভ ওয়েটে কেজি দরে বিক্রি করেন। দেখলাম গরুগুলো বেশ তাজা এবং চঞ্চল।
প্রকৌশলী মকবুল হোসেনের মতো অনেকেই কোরবানি ঘিরে গড়ে তুলেছেন ছোট-বড় অনেক খামার। কোনো কোনো খামার বিশাল, একেবারে শিল্পকারখানার আদল। কেউ কেউ দুটি-তিনটি করে গরু লালনপালন করে কোরবানিতে বাড়তি আয়ের একটা চেষ্টা করে চলেছেন। আবার কোনো কোনো খামার দেখলেই মনে হয় যেন গরু মোটাতাজাকরণের কুটিরশিল্প। ছোট্ট আকারে শুরু হলেও বাণিজ্যের প্রসারে এও যে একসময় বিশাল হয়ে উঠবে তার ধারণাও পাওয়া যায়।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, এ বছর ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১৯ হাজার বেশি। আসন্ন ঈদুল আজহায় ১ কোটি ১০ লাখ পশু কোরবানি হতে পারে। গত বছর গবাদি পশু প্রস্তুত ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি। কোরবানি হয়েছিল ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৭টি। বোঝাই যাচ্ছে ক্রমেই বড় হচ্ছে কোরবানির পশুর বাজার। ফলে তরুণ খামারিরাও যুক্ত হচ্ছেন গরু মোটাতাজাকরণে।
এমনই এক তরুণ খামারি সাইদুর রহমান শিমুল। মেঘনার তীরে নরসিংদী পৌরসভার কামারগাঁওয়ে গড়ে তুলেছেন তার গরুর খামার। শিমুল পেশায় শিক্ষক, করোনার এই সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং নিরাপদ খাদ্যের তাগিদ থেকেই যুক্ত হয়েছেন কৃষি খামারে। শিমুলের খামার গড়ে তোলার গল্পটা দারুণ। শিক্ষক বলেই এ সময়ের বাচ্চাদের তিনি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, তাদের শৈশবে তারা যেমন দুরন্ত ছিলেন, উচ্ছল ছিলেন এই বাচ্চারা ঠিক সে রকম নয়।
তিনি অনেক কারণের একটা বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করলেন অনিরাপদ খাদ্যব্যবস্থাকে। চিন্তা করছিলেন কীভাবে তার ছাত্র-ছাত্রী, সন্তানের মুখে নিরাপদ খাদ্য তুলে দেবেন। সেই তাগিদ থেকেই প্রথমে যুক্ত হন ফসল কৃষির সঙ্গে। এর মাঝে চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত যশোরের মাহবুবুল ইসলামের ভুটানি বক্সার গরুর প্রতিবেদন দেখে সেই গরু লালনপালনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পাঠক, আপনাদের মনে থাকতে পারে বছর চারেক আগে যশোরের মাহবুবুল ইসলামের ভিন্ন রকমের গরু-ছাগলের খামার নিয়ে একটি প্রতিবেদন তুলে ধরেছিলাম। সেখানে মাহবুবুল ইসলাম নানারকম ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এবং খাটো জাতের ভুটানি বক্সার গরু লালনপালন করছিলেন বেশ সাফল্যের সঙ্গে। সে প্রতিবেদন দেখে শিমুলও খুঁজতে থাকেন ভুটানি বক্সার।
একদিন খবর পেলেন ভারতের সীমান্তের সীমান্তরক্ষীরা কিছু ভুটানি গরু নিলামে তুলেছেন। ছুটে গেলেন। না, ভুটানি বক্সার নয়, সেই গরু মূলত ভুটানি ভুট্টি জাতের। এও ছোট আকৃতির এক গরু। সেখান থেকে ২৬টি গরু তিনি নিলামে কিনে নিয়ে আসেন। এর সঙ্গে গরু মোটাতাজাকরণের একটা খামার গড়ে তোলার স্বপ্নও যুক্ত হয় শিমুলের।
আগেই বলেছি শুধু শখের বশে নয়, নিরাপদ খাদ্যের তাগিদ থেকে শিমুল যুক্ত হয়েছেন কৃষি উদ্যোগের সঙ্গে। তাই গরুর খাবার দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি বেশ সচেতন। নিজেই গরুর খাবার তৈরি করেন। ১০ বিঘা জমিতে চাষ করেন জার্মানি হাইব্রিড ঘাস। আর নিজের জমিতে চাষ করা ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী, খড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করেন দানাদার খাবার। শিমুলের মতো অজস্র খামারির হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের পশুসম্পদ খাত।
দেশে প্রতি বছর গবাদি পশুর খামারির সংখ্যা বাড়ছে। ভারত থেকে গরু আসা বন্ধের পর ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা গবাদি পশু লালনপালনে উদ্যোগী হন। করোনার এই সময়ে এসে সেই সংখ্যাটা বেড়েছে। এ উদ্যোক্তার প্রায় ৮০ শতাংশই তরুণ, বলা চলে শিক্ষিত তরুণ। অনেকে মূল পেশার পাশাপাশি গবাদি পশুর খামার গড়ে তুলছেন। প্রাণিসম্পদে জোয়ার আসবে আমাদের দেশে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের দেশে উৎপাদিত মাংসের বাজার ছড়িয়ে দিতে নিতে হবে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ। তবেই আরও সমৃদ্ধ হবে খামারশিল্প, সমৃদ্ধ হবে দেশ। করোনা মহামারীর এই সময়ে সচেতন থাকুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, নিরাপদ থাকুন।
লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
[email protected]