তৃতীয় লিঙ্গের খামারী খুকুমনির ভাগ্যবদল
প্রাণিসম্পদ
তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠির এক সদস্যের নাম খুকুমনি। শেরপুর সদর উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের বাদাতেগরিয়া গ্রামের খুকুমনি কিছুদিন আগেও ছিলেন অসহায় ও ভবঘুরে। আজ সে স্বাবলম্বী। দাঁড়িয়েছেন নিজের পায়ে। অন্যের দ্বারে-দ্বারে ঘুরে এখন নিজের বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন বড় একটি হাঁসের খামার। বর্তমানে তার খামারে হাঁস রয়েছে ১ হাজারেরও অধিক। হাঁসগুলোর সঙ্গে খুকুমনির দারুণ বন্ধুত্ব।
খুকুমণি বলেন, “বাজার থেকে প্রতিটি হাঁসের বাচ্চা কেনা পড়েছে ২৫ টাকা ধরে। মোট বাচ্চা কিনেছি ১ হাজার ২০০ এর মতো। এখন সব মিলিয়ে ১ হাজারের মতো বড় হাঁস রয়েছে আমার খামারে”।
তিনি আরও বলেন, “এর আগেও হাঁস পালন করে ৪০ হাজার টাকা লাভ করেছি। ওই লাভের টাকা দিয়েই ধীরে-ধীরে খামার বড় করছি। এখন যে হাঁসগুলো রয়েছে, প্রতিটির বর্তমান বাজারদর ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা করে হবে। আড়াই মাস পর সব খরচ বাদ দিয়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাভ হবে বলে ধারণা করছি। তৃতীয় লিঙ্গের একজন হলেও মানুষের কাছে আমি হাত পাততে চাই না। আমি কর্ম করে বাঁচতে চাই। সরকার আমাকে একটি ঘর আর জমি দিয়েছে। আমি এখানেই হাঁস-মুরগি পালন করে বেঁচে থাকতে চাই। আমার দাবি, অন্যদের মতো যেন আমাকেও সরকার সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থাটা করে দেয়”।
জানা যায়, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হওয়ায় যেখানে-সেখানে তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হতো খুকুমণিকে। তাই বেঁচে থাকার জন্য একসময় হাত পাতা আর চাঁদা তোলা শুরু করেন তিনি। এত করে তাকে অপমান-বঞ্চনা সইতে হতো। একদিন তিনি সিদ্ধান্ত নেন আর ওইসব কাজ করবেন না। এরপর প্রশিক্ষণ নেন যুব উন্নয়ন কেন্দ্রে। সেখান থেকে অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে হাঁসের খামার গড়ে তুলেন। দিনে দিনে বড় হতে থাকে ওই খামার। অল্পদিনেই আসে সফলতা। খুকুমনি আজ স্বাবলম্বী।
এদিকে, প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, জেলায় বসবাসকারী তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যসংখ্যা ৫২। প্রশিক্ষণ পেয়ে তাদের সবাই এখন স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
স্থানীয় অধিবাসী জুবাইদুল ইসলাম বলেন, খুকুমণি ছোট থেকেই বুদ্ধিমতী। কারণ, বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে নিজে কিছু করার চেষ্টা করতো। সে সমাজের অন্যদের মতো চাঁদাবাজি, বাজারে বাজারে টাকা তোলা, জোর করে নেওয়া, এগুলো করতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে খামার গড়েছেন। অল্প কিছু হাঁস পালন করে আজ তার খামারে ১ হাজারেরও বেশি হাঁস রয়েছে। খুকুমণির জন্য আমরা এলাকাবাসী গর্বিত।
এ ব্যাপারে শেরপুর জেলা হিজড়া কল্যাণ সমিতির সভাপতি নিশি সরকার জানান, আমরাও সমাজের অন্যদের মতোই মানুষ। আমাদেরও পরিবার ছিল। মা, বাবা, ভাই-বোন ছিল। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে আমরা পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরাও যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি। কিছু একটা করে স্বাবলম্বী হতে পারি, তার জ্বলন্ত উদাহরণ খুকুমণি।
তিনি বলেন, শুধু তা-ই নয়, শেরপুরের অনেক হিজড়া আছে, যারা মাস্টার্স শেষ করেছে। কেউ আবার শেরপুর সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট বা অনার্স পরছে। অনেকেই সেলাই, বুটিক, কম্পিউটার, গবাদিপশু পালনসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
শেরপুরের তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় নাগরিক সংগঠন জন উদ্যোগ। সংগঠনটির শেরপুর জেলার আহ্বায়ক শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ বলেন, “একসময় ট্রান্সজেন্ডারদের (তৃতীয় লিঙ্গের সদস্য) কেউ ঘর ভাড়াও দিতে চাইত না। সময়ের পরিবর্তনে আমরা সব দাবি আদায় করেছি। শেরপুর সদরের কামারিয়া ইউনিয়নে ২ একর জায়গায় ৬৯ লাখ ৪ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য বাসস্থান ‘স্বপ্নের ঠিাকানা’ আবাসন প্রকল্প। ইতোমধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের ৪০ সদস্যের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে নতুন ঘরের চাবি”।
শেরপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা (ইউএনও) ফিরোজ আল মামুন জানান, আমরা তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যদের জমি ও ঘরের ব্যবস্থা করেছি। প্রশিক্ষণ প্রদান করছি। বর্তমানে ঋণ প্রদানও শুরু করেছি। খুকুমণির বিষয়টি আমাদের ধারণায় রয়েছে। তার মতো অন্যরাও যেন স্বাবলম্বী হতে পারে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।