বোরো আবাদে ভূগর্ভস্থ পানিস্তরের অবনমন হয় না : কৃষিমন্ত্রী
কৃষি বিভাগ
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এমপি বলেছেন, বোরো ধান চাষে ভূগর্ভস্থ পানিস্তরের অবনমন হয় না। প্রতি কেজি বোরো ধান উৎপাদনে প্রায় ৩০০০ থেকে ৫০০০ লিটার সেচের পানির প্রয়োজন হয় বলে ধারণা (মিথ) প্রচলিত ছিল। কিন্তু ব্রির গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের নিয়ন্ত্রিত সেচ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাত্র ১০০০ থেকে ১৬০০ লিটার সেচের পানি দিয়ে কৃষকরা সফলভাবে ১ কেজি ধান উৎপাদন করছেন।
শুধু সেচ বিবেচনায় এই পানির প্রয়োজন আরো কম। যার মধ্যে আনুমানিক ৪০ শতাংশ (৪০০ থেকে ৬৫০ লিটার) সীপেজ ও পারকুলেশনের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে মিশে যায়। সুতরাং ধান উৎপাদনে প্রকৃত পানির প্রয়োজন হয় ৫৫০ থেকে ৬৫০ লিটার/কেজি। অতএব, বোরো ধান চাষে পানির অপচয় নিয়ে যে সমাজে প্রচলিত বিভ্রান্তি ছিল ব্রি ও সহযোগী সংস্থাগুলোর এই গবেষণা ফলাফলের মাধ্যমে অবসান হবে।
রবিবার (১৬ জানুয়ারি) বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে এবং অস্ট্রেলিয়ার কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিএসআইআরও), ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ড (ইউএসকিউ), এসিএআইআর ও অস্ট্রেলিয়ান এআইডির সহযোগিতায় আয়োজিত ‘উত্তর-পশ্চিম বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্থায়িত্ব এবং ধান উৎপাদন’ শীর্ষক ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন কৃষিমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে জুম প্ল্যাটফর্মে যুক্ত ছিলেন- কৃষিসচিব মো. সায়েদুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মো. বখতিয়ার, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান এ এফ এম হায়াতুল্লাহ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম এবং বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রশীদ।
ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত হয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বোরো ধানে পানির অপচয় নিয়ে যে বিভ্রান্তি সমাজে প্রচলিত ছিল ব্রি ও সহযোগী সংস্থার এই গবেষণা ফলাফলের মাধ্যমে সে বিভ্রান্তির অবসান হবে।
তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ এই সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের উচিত এ ধরনের বিভ্রান্তি নিরসনে একযোগে গবেষণার কাজ পরিচালনা করা।
বিশেষজ্ঞ প্যানেলে যুক্ত ছিলেন প্রফেসর ইমিরেটাস ও সাবেক উপাচার্য, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ড. এম এ সাত্তার মণ্ডল এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. হামিদুর রহমান। ওয়েবিনারে দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং প্রধান ড. মো. মনিরুজ্জামান, এবং কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশন (সিএসআইআরও) অস্ট্রেলিয়ার প্রিন্সিপাল রিসার্চ সায়েন্টিস্ট ড. মো. মাঈন উদ্দিন।
বিশেষজ্ঞ প্যানেলের আলোচনায় প্রফেসর ইমিরেটাস ড. এম এ সাত্তার মণ্ডল বলেন, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার জন্য বোরো ধানের আবাদই একমাত্র দায়ী নয়। শুষ্ক মৌসুমে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী-নালা, খাল-বিলে পানির প্রবাহ কম থাকায় বেজ ফ্লো হিসেবে ভূ-গর্ভস্থ পানির একটি অংশ নদীতে চলে যাচ্ছে। ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে বন্যার পানি প্রথমে ভূ-গর্ভস্থ পানির সেই খালি জায়গা পূরণ করার ফলে বন্যার তীব্রতা হ্রাস পাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রাক্তন মহাপরিচালক ড. হামিদুর রহমান বলেন, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে টেকসই ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনা করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগসহ ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। নদী-নালা, খাল-বিলে পানির সংরক্ষণের পরিমাণ ব্যবহার বৃদ্ধি করতে পারলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সাফল্যজনকভাবে ধানসহ অন্যান্য ফসল চাষাবাদ সম্ভব হবে।
কর্মশালার দুই প্রবন্ধকার জানান, কৃষিকাজে ভূ-গর্ভস্থ পানির অধিক ব্যবহারের ফলে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কোনো কোনো জায়গায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর কিছুটা নিচে নেমে যাচ্ছে। এ সমস্যাকে সামনে রেখে ভূ-গর্ভস্থ পানির সুষ্ঠু ব্যবহার, ধান উৎপাদনে প্রকৃত পানির পরিমাণ ও স্বল্প খরচে ধান উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ব্রি ও অস্ট্রেলিয়ার সিএসআইআরো এবং ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ড (ইউএসকিউ) এবং এসিআইএআর, অস্ট্রেলিয়া গত পাঁচ বছর ধরে কয়েকটি গবেষণা কাজ সম্পন্ন করেছে।
এসব গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, বিগত ১০ বছরে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বোরোর এলাকা বাড়েনি, তবে উন্নত জাতসহ অন্যান্য কারণে বোরোর ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তা ছাড়া বোরো ধানের উচ্চ ফলনশীল জাতের ব্যবহার ও ক্রপিং প্যাটার্নভিত্তিক ফসল চাষাবাদের মাধ্যমে জমির উৎপাদনশীল ও ফসলের পানি ব্যবহার দক্ষতা আরো বাড়ানো সম্ভব।
সভাপতির বক্তব্যে ব্রি মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবীর বলেন, সারা দেশে বোরো ধান চাষে সেচের পানির ব্যবহারের ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে- এ ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা ঠিক নয়। শুধু ঠাটা বরেন্দ্র অঞ্চলে কিছু এলাকায় এটি হতে পারে। ভূ-গর্ভস্থ অ্যাকুয়াফায়ারগুলো পানির রিজার্ভার হিসেবে কাজ করে। সুতরাং এসব নেতিবাচক প্রচারণায় বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
এ সময় জুমে আরো যুক্ত ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, অধীন সংস্থা ও দপ্তরগুলোর প্রধানগণ অন্যান্য জাতীয় ও অন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রধানরা; বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন বিজ্ঞানীরা; প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরাসহ ব্রি ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।