সয়াবিন উৎপাদনে আগ্রহ বাড়ছে সরকারের
কৃষি বিভাগ
সয়াবিন তেল নিয়ে অনেকটাই বিব্রত সরকার। আমদানিনির্ভর পণ্যটির দাম আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। ফলে দেশীয় বাজারে এর দাম নিয়ে সারা বছরই অস্বস্তিতে থাকতে হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। এখনও এ নিয়ে নানা সংকট সামলাতে হচ্ছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে। যে কারণে সয়াবিন উৎপাদনে আগ্রহ বেড়েছে সরকারের। কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেলো এ তথ্য।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২০ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ২ লাখ টন। এর মধ্যে সরিষা, তিল, তিশি উল্লেখযোগ্য। আমদানির মধ্যে সয়াবিন ও পামই বেশি। এর মধ্যে আবার বেশি আমদানি হয় পাম তেল। যদিও এর সঙ্গে একমত নন অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানিকারকরা। তাদের ভাষ্য, চাহিদার ১৮ লাখ টন ভোজ্যতেলের মধ্যে ১৩ থেকে ১৪ লাখ টন সয়াবিন তেল আমদানি হয় ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র ও আর্জেন্টিনা থেকে।
বর্তমানে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায়। এ দাম আরও বাড়াতে সরকারের সঙ্গে দেনদরবার চলছে আমদানিকারকদের। ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থাকলেও সরকারের সিদ্ধান্তকে অমান্য করে কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে নিজেদের মতো প্রতি লিটারে ৫ টাকা বাড়িয়েছে।
এ সব কারণেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে সয়াবিন উৎপাদনে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, সয়াবিন বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেলবীজ ফসল। বর্তমানে বাংলাদেশে যা সয়াবিন উৎপাদিত হয় তা চাহিদার তুলনায় নগণ্য। তাই বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা উন্নত জাত উদ্ভাবনের চেষ্টার অংশ হিসেবে সয়াবিনের একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন। জাতের নাম ‘বিনা সয়াবিন-২’। বাণিজ্যিকভাবে সারা বছর চাষাবাদের জন্য এটাকে ছাড়পত্র দিয়েছে জাতীয় বীজ বোর্ড।
এ জাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এর প্রধান উদ্ভাবক উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আব্দুল মালেক জানিয়েছেন, ‘গাছটির উচ্চতা রবি মৌসুমে ২৭-৪০ সেন্টিমিটার এবং খরিফ-২ মৌসুমে ৩৫-৪২ সেন্টিমিটার হয়। প্রাথমিক শাখার সংখ্যা ৩-৫টি। প্রতি গাছে ফলের সংখ্যা ৪০-৫০টি। বীজ মাঝারি আকারের হয়। ১০০ বীজের ওজন ১৩ গ্রামের মতো হয়। বীজে আমিষ, তেল এবং শর্করার পরিমাণ যথাক্রমে ৪৩, ১৯ এবং ২৬ শতাংশ।’
তিনি আরও জানান, ‘রবি এবং খরিফ-২ মৌসুমে এ জাতের জীবনকাল ১১৫ এবং ১১৭ দিন। এ দুই মৌসুমে প্রতি হেক্টরে যথাক্রমে ২.৫-২.৮ এবং ২.৭-৩.৩ টন ফলন পাওয়া যায়।’
সম্প্রতি সয়াবিন সাপ্লাই চেইন উন্নয়ন শীর্ষক একটি পলিসি সভায় অংশগ্রহণকারীরা বাংলাদেশে সয়াবিন উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে সমন্বিত উদ্যোগের ওপর জোর দিয়েছেন। ‘সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া’র উদ্যোগে ঢাকাস্থ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত পলিসি সভায় সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নীতিনির্ধারক, উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে সয়াবিন উৎপাদন ও বাজার উন্নয়নের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন।
পাশাপাশি খাবার, পশুখাদ্য, মাছের খাদ্য এবং তৈল শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ও ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা প্রদানেও জোর দিয়েছেন তারা।
টেকসই পদ্ধতিতে সয়াবিনের উৎপাদন, সরবরাহ এবং ভ্যালু চেইন উন্নয়নের জন্য সমন্বিত ও বহু-অংশীজনভিত্তিক উদ্যোগে গুরুত্বারোপ করেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশিদ ভুঁইয়া। উন্নত জিনগত বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ সয়াবিনের জাত নিয়ে আরও গবেষণার আহ্বান জানান তিনি।
উত্তরাঞ্চলেও শুরু হয়েছে:
এতদিন নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল ও ফরিদপুরে সয়াবিনের চাষ হতো। এবার শুরু হয়েছে নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, ও ঠাকুরগাঁও জেলায়।
উত্তরাঞ্চলের এ সাত জেলার দেড় হাজার বিঘা জমিতে সয়াবিনের চাষ হয়েছে। আগামী বছর ৫০ হাজার বিঘায় চাষের পরিকল্পনা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সয়াবিনের উৎপাদন বাড়াতে পারলে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) নোয়াখালী অঞ্চলের সরেজমিন গবেষণা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশের অন্তত ৩৩ জেলার ৭২টি উপজেলায় তিন থেকে চার লাখ হেক্টর জমিতে সয়াবিনের চাষ হচ্ছে। এখান থেকে বছরে ১০ লাখ মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদন হয়। যার শতকরা ৬০ ভাগই হয় লক্ষ্মীপুরে।
উদ্যোক্তারা জানান, সয়াবিন উৎপাদনের প্রধান সমস্যা ছিল বীজ। এবার চরে উৎপাদিত সয়াবিনের মাধ্যমে বীজ সমস্যার সমাধানও হবে।
এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সয়াবিন চাষের উপযোগী জমি রয়েছে। ক্রমান্বয়ে কৃষকরাও আগ্রহী হচ্ছেন। প্রয়োজনে সরকারি সহায়তার পরিমাণ বাড়বে।’
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, ‘পেঁয়াজ উৎপাদন বেড়েছে বলে গতবছর পেঁয়াজ নিয়ে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। আশা করছি দেশে সয়াবিনের উৎপাদন বাড়লে এ নিয়ে আর আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না।’