মধু সংগ্রহে মৌচাষে ঝুঁকছেন যুবকরা
এগ্রিবিজনেস
জয়পুরহাটের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সরিষার খেত। এবার জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। সরিষার গাছে গাছে হলুদ ফুল আর সেই ফুলের মৌ মৌ গন্ধ। মৌমাছি তার গুনগুন শব্দে মধু আহরণে ব্যস্ত। এসব মধু সংগ্রহ করতে সরিষাখেতের পাশে বাক্স বসিয়েছেন মৌচাষিরা। এতে মৌমাছির মাধ্যমে সরিষা ফুলের পরাগায়ন হচ্ছে। ফলে একদিকে সরিষার উৎপাদন বাড়ছে, অন্যদিকে মধু আহরণ করা যাচ্ছে। সমন্বিত এই চাষে সরিষা ও মৌচাষি উভয়ই লাভবান হচ্ছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত মৌসুমে ১১ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। আর চলতি মৌসুমে জেলার পাঁচ উপজেলায় ১১ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। চলতি মৌসুমে ১২ হাজার ২০৫ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়, যা গত বছরের চেয়ে ১ হাজার ১৭৫ হেক্টর জমিতে সরিষা বেশি চাষ হয়েছে।
এসব খেতের পাশে বিভিন্ন দলের মৌচাষিরা তাদের বাক্স স্থাপন করেছেন। আর বাক্স থেকে এবার ৩০ মেট্রিক টন মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আরও অন্তত ১৫ দিন বিভিন্ন এলাকায় মধু আহরণ চলবে বলে মৌচাষিরা জানিয়েছেন।
সদরের পুরানাপৈল দস্তপুর গ্রামের কৃষক ছাইদার হোসেন বলেন, আমি একজন কৃষক। সাড়ে ৫ বিঘা জমিতে সরিষা আবাদ করেছি। জমির পাশেই মৌমাছি থেকে মধু সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই মৌমাছি চাষে মধু সংগ্রহের ক্ষেত্রে গত বারের চেষে এবার ফলন ভালো হবে এবং হচ্ছে।
মৌচাষের প্রশিক্ষণ নিয়ে গত বছর ২৫ বাক্স দিয়ে এই চাষ শুরু করেছিলেন মো. নয়ন। তিনি বলেন, গত বছর মধুতে ভালো লাভবান হওয়ার কারণে এ বছর ১৫০টি বাক্স নিয়ে শুরু করেছি। উত্তরবঙ্গের জয়পুরহাট একটি মৌচাষের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। সরকার থেকে যদি আরও সহযোগিতা পাই তাহলে এটি বৃহত্তর করা সম্ভব ছিল।
এ বছরের ২ জানুয়ারি থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত মৌচাষের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সদরের দস্তপুর গ্রামের বাসিন্দা আবু ইউসুফ। তিনি বলেন, আমি প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর জানলাম এই কাজে আমরা সফলতার দ্বারপ্রান্তে উঠতে পারব। আমরা পড়াশোনা শেষ করেই চাকরির জন্য এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াই। আমাদের বেকারত্ব দূর করার জন্য। আমরা অনেক জায়গায় দরখাস্ত করি। কিন্তু এতো কর্মক্ষেত্র নেই। তাই আমরা এই মৌচাষ শুরু করলে অল্প সময়ে এবং অল্প পুঁজি দিয়ে লাভবান হতে পারব।
দস্তপুর মাঠে সরিষা চাষ ও সেখানে মৌবাক্স দিয়ে মধু আহরণ করা হচ্ছে। তাই পাঁচবিবি উপজেলা থেকে মধু কিনতে এসেছেন আহমেদ আব্দুল মাজেদ। তিনি বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক মানুষ এখানে আসছেন। আমিও আসছি। এতে অনেকে আগ্রহী হয়ে মধু কিনছেন। আমিও কিনব। এটা খুবই ভালো ও আমরা সহজেই মধু পাচ্ছি।
১৯৭৭ সাল থেকে মৌমাছি চাষের সঙ্গে জড়িত আছেন হাফিজুর রহমান। তার বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার গোমানিগঞ্জ মিরকুচিমদন গ্রামের বাসিন্দা। তিনি দিনাজপুর বিসিকের সহকারী কারিগরি কর্মকর্তা ও মৌমাছি পালনের সঙ্গে যুবক উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেন।
তিনি বলেন, ১৯৭৭ সাল থেকে এই চাষ শুরু করে প্রথম তিন বছর বাড়িতে নিজেই মধু আহরণ করি। এ রকম দেখে আমাকে ধরে নিয়ে এই প্রকল্পে চাকরি দেয় এবং তখন থেকেই বেশি করে এ কাজে জড়িয়ে পড়ি। এখন পর্যন্ত আমি অনেক চাষিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা এখন দেশে অনেক কিছু করবে এবং করতে পারছে। সরিষা, ধনিয়া, খেসারি, কালজিরা, লিচু, মিষ্টি কুমড়া, তিলসহ অনেক ফসলের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা যায়।
তিনি আরও বলেন, একজনকে প্রশিক্ষণ নিতে হলে সঙ্গে ছবি, ভোটার আইডি ও ফি হিসেবে ৫০০ টাকা দিতে হয়। প্রশিক্ষণ শেষে আমরা একটি করে মৌ বাক্স দেই। একটি বাক্সে ১০টি ফ্রেম লাগানো যায়। এক ফ্রেম মৌমাছি নিতে ৭০০ টাকা খরচ করতে হয়। বর্তমানে সরকারিভাবে সরিষার মধু ৫০০ টাকা কেজি। কিন্তু আমরা ৪০০ টাকা হিসেবে বিক্রি করছি।
জয়পুরহাট বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক লিটন কুমার ঘোষ বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ইতোপূর্বে এ জেলায় ১০০ জনকে তিন ক্যাটাগরিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও তাদের মৌবাক্স, মধু নিষ্কাশন যন্ত্রসহ যাবতীয় কিছু দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেককেই আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে। এখনও অনেকেই প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এ জেলায় এবার ৩০ টন মধু আহরণ হবে বলে আমরা আশা করছি। ভবিষ্যতে তাদের জন্য সরকারিভাবে কোনো আর্থিক সহায়তা আসলে তা দেওয়া হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ শফিকুল ইসলাম বলেন, জেলায় এবার ১ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। ইতোমধ্যে সরিষায় ফুল আসছে এবং সেই ফুলে মৌমাছির আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সরিষা তৈলাক্ত ফলস হিসেবে আমাদের দেশে সমাদৃত। গত বছরের তুলনায় এবার জেলায় সরিষা আবাদ বেশি হয়েছে। সরিষার ফুল আসা অবস্থায় অনেক মৌচাষিরা মৌবাক্স স্থাপন করেছে। আমরা কৃষি বিভাগ থেকে অনেক কৃষককে মৌবাক্স ও প্রশিক্ষণ দিয়েছি।