দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের ভেড়া উন্নয়নে খুবির এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের গবেষণা
মতামত-ফিচার
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল প্রধানত চিংড়ি চাষ নির্ভর।এখাকার বিস্তীর্ণ ভূমিতে সারাবছর বেড়িবাঁধ দিয়ে লবণপানি আটকে রেখে চিংড়ি চাষ করা হয়। সারাবছর জলমগ্ন থাকায় এসব এলাকায় গবাদিপশুর জন্য চারণভূমির ব্যাপক সংকট রয়েছে। গরু-মহিষের মত বৃহৎ আকারের প্রাণীদের খাদ্য চাহিদা ও চারণভূমি উভয়ের প্রয়োজন বেশি হয়।তাই এ অঞ্চলে এদের পালন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ভেড়া উপকূলীয় এলাকার জলবায়ুতে অধিকতর অভিযোজনক্ষম প্রাণী এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এদের উপর তেমন প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়না। তাই বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এদের প্রতিপালনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
সাধারণত ভেড়ার রোগবালাই কম হয় এবং আকারে ছোট হওয়ায় খাবারের প্রয়োজন তুলনামূলকভাবে কম। রাস্তার পাশে, জমির আইলে এবং চিংড়ি ঘেরের বেড়িবাঁধে যে প্রাকৃতিক ঘাস জন্মায় সেখানে প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা চরে এরা সারাদিনের খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে পারে।উপকূলীয় অঞ্চলের ভেড়া অধিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন। এরা ১৪ মাসে দুইবার বাচ্চা দিয়ে থাকে এবং প্রতিবারের ২-৩টি বাচ্চা প্রসব করে। এরা গাছের বা ফসলের তেমন ক্ষতি করেনা।এছাড়াও লবণাক্ত এলাকাতে এরা যথেষ্ট সহনশীল বলে পরীক্ষিত।তাই অল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে উপকূলীয় অঞ্চলে সহজে ভেড়া পালনে লাভবান হওয়া সম্ভব।
তবে উপকূলীয় অঞ্চলের ভেড়া আকারে ছোট এবং দৈহিক বৃদ্ধির হার কম সুতরাং বড় জাতের ভেড়ার সাথে সংকরায়নের মাধ্যমে এ জাতের উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে চলমান উপকূলীয় ভেড়া উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এবং বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো-এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিন গবেষণা প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ করছে।
বর্তমানে এ গবেষণা প্রকল্পের আওতায় মোট ২৬টি সংকর জাতের বাচ্চা উৎপাদিত হয়েছে যদের আকার আকৃতি ও শৌর্য-বীর্যে আকর্ষণীয়। প্রকল্প পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন ড. সরদার শফিকুল ইসলাম, প্রফেসর এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। সহযোগী প্রকল্প পরিচালক ড. মোঃ সফিকুল ইসলাম, প্রফেসর এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় খুলনা। এছাড়া গবেষক হিসেবে রয়েছেন মাষ্টার্স এ অধ্যায়নরত গবেষক মিস মণীষা দে। এবং গবেষণা সহকারী জনাব মিনহাজুল আবেদীন সান। ভেড়াদের নিয়মিত দেখাশোনা করছেন প্রতাপ মল্লিক।
প্রকল্প পরিচালক ড. সরদার শফিকুল ইসলাম এগ্রিভিউ২৪কে বলেন, “বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের স্থানীয় জাতের ভেড়া সাধারণত আকারে ছোট হয়, এদের দৈহিক বৃদ্ধির হার কম এবং প্রাপ্তবয়স্ক ওজন কম হয়ে থাকে অর্থাৎ মাংস উৎপাদন ক্ষমতা অনেক কম হয়। অতএব উপকূলীয় অঞ্চলের স্থানীয় জাতের ভেড়ার উন্নয়ন করা দরকার। এ ক্ষেত্রে উন্নত জাতের পাঠা দিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলের স্থানীয় জাতের ভেড়ীকে পাল দেওয়া হলে, যে বাচ্চা জন্ম নেবে সেটাই হবে সংকর জাতের এবং এদের আকার ও মাংস উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। ”
বাংলাদেশের মেহেরপুর এবং চুয়াডাঙ্গা জেলাতে এক বিশেষ ধরনের বড় জাতের ভেড়া দেখা যায় যা স্থানীয়ভাবে গাড়োল জাতের ভেড়া নামে পরিচিত। গাড়োল প্রজাতির ভেড়া আকারে অনেক বড় হয় এবং এদের দৈহিক বৃদ্ধির হার অনেক বেশি হয়ে থাকে। এরা দেখতেও সুন্দর হয়, এদের লেজ বেশ খানিকটা লম্বা হয় এবং প্রায় মাটি পর্যন্ত স্পর্শ করে। গাড়োল প্রজাতির পাঠা দ্বারা উপকূলীয় অঞ্চলের ভেড়ীকে প্রজননের মাধ্যমে জাতের উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব। উৎপাদিত সংকর জাতের ভেড়া আকারে বড় হবে এবং এদের দৈহিক বৃদ্ধির হারও বেশি হবে। এভাবে একদিকে যেমন ভেড়ার জাতের উন্নয়ন ঘটবে, অন্যদিকে মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
তিনি আরও জানান, “প্রাকৃতিক ঘাসের পাশাপাশি ভেড়াকে কি পরিমাণ দানাদার খাবার দিলে এবং দিনে কত ঘন্টা মাঠে চরলে বৃদ্ধির হার সর্বাধিক হবে, একই প্রকল্পের আওতায় সে বিষয়ে গবেষণা চলছে। প্রকল্পের ভেড়াগুলোকে পৃথক দলে ভাগ করে আলাদা আলাদা চেম্বারে রাখা হয়েছে। প্রাকৃতিক ঘাসের পাশাপাশি প্রতিটি দলকে ১০০, ১৫০, ২০০ ও ২৫০ গ্রাম হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ দানাদার খাবার দেওয়া হয়। বিভিন্ন প্রকার দানাদার খাদ্য উপাদান যেমন ভূট্টা ভাংগা, চালের কুড়া, গমের ভূষি, সরিষার খৈল, সয়াবিন মিল, খাদ্য লবণ, ডিসিপি এবং ভিটামিন মিনারেল প্রিমিক্স সমন্বয়ে দানাদার মিশ্রণ তৈরি করা হয়।“
বাংলাদেশে প্রাপ্ত জাতের ভেড়া সমূহ মূলত মাংস উৎপাদনকারী। ভেড়ার মাংস তুলনামূলক নরম সুস্বাদু রসালো হয় এবং এতে কোনো গন্ধ থাকে না।
ভেড়ার মাংসের জিংক এবং আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকে যা বাচ্চাদের দৈহিক বৃদ্ধি, টিস্যু পুনর্গঠন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া ভেড়ার মাংসের কারনিটাইন নামক অ্যামাইনো এসিড থাকে যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ভেড়ার মাংসের সাথে গরু এবং ছাগলের মাংসের পুষ্টি উপাদনের তুলনামূলক পার্থক্য নিম্নরূপঃ
পুষ্টি উপাদন | ভেড়া | গরু | ছাগল |
পানি (%) |
৭৫ | ৭৪ | ৭৪ |
আমিষ (%) |
২৩ | ২২ |
২২ |
চর্বি (%) | ৩ | ৩ |
৩ |
শক্তি (কিলোজুল/১০০গ্রাম) | ৫৪৬ | ৪৯৮ |
৫১৪ |
জিংক (মিলিগ্রাম/১০০গ্রাম) |
৪.৫ | ৪.৫ | ৪.২ |
কপার (মিলিগ্রাম/১০০গ্রাম) | ০.২২ | ০.১২ | ০.০৮ |
ফসফরাস (মিলিগ্রাম/১০০গ্রাম) | ২৯০ | ২১৫ |
২৬০ |
ভিটামিন-সি (মাইক্রোগ্রাম/১০০গ্রাম) |
১০০০ | ১৫০০ |
– |
ক্যালসিয়াম (মিলিগ্রাম/১০০গ্রাম) | ১০ | ১০ |
১০ |
সোডিয়াম (মিলিগ্রাম/১০০গ্রাম) |
৮০ | ৪০ | ৭৭ |
পটাশিয়াম (মিলিগ্রাম/১০০গ্রাম) | ৪০০ | ৪০০ |
৩০০ |
কোলেস্টেরল (মিলিগ্রাম/১০০গ্রাম) | ৭০ | ৭৬ | ৭০ |
কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভেড়ার মাংসের এত উৎকৃষ্টতার স্বত্তেও, আমাদের দেশে ভেড়ার মাংসের জনপ্রিয়তা তেমনভাবে লক্ষ্য করা যায়না। ভেড়ার মাংসকে জনপ্রিয় করার জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহন করা যেতে পারেঃ
১. মাঠে-ঘাটে ছাড়া অবস্থায় ভেড়া অনেক সময় কাদাপানি ও ধুলা-বালিতে থাকে যার কারণে এদের অপরিষ্কার দেখায়। কাজেই বাজারে আনার আগে ভালোভাবে পরিষ্কার করে গোসল করিয়ে আনতে হবে যাতে ক্রেতারা এদের পছন্দ করে।
২. ভেড়ার মাংসের গুণগতমান ও পুষ্টি সম্বন্ধে জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পোস্টার, ফেস্টুন, লিফলেট ইত্যাদি বিতরণের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
৩. সেই সাথে সংশ্লিষ্ট খামারিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
আরো পড়ুনঃ মালচিং ও জৈব প্রযুক্তি অনুসরণে খুবিতে বেগুনি ক্যাপসিকাম চাষে সাফল্য