কৃষিতে বাংলাদেশের নারীদের অবদান
মতামত-ফিচার
জমিলা বিবি, বয়স ৩২; বিয়ে হয়েছিল ঠিক ১৫ বছর বয়সে। ফরিদপুরের পাটচাষী রহিমের সাথে সংসার করছেন ১৭ বছর। এরপর দুই মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে সংসার এগিয়ে গেলেও, সংসারের হাল স্বামীর সাথে ধরতে হয়েছিল তাকেও। দেশে পাটচাষীদের বেহাল দশাতেও তিনি হাল ছাড়েন নি। লড়ে গেছেন শক্ত হাতে। পুব আকাশ ফুরে সূর্য বেরোবার আগেই তার জীবন সংগ্রাম শুরু হয়। দুদিন হলো বোরো ধানের যে জমিটা ছিল, সেটা পরিষ্কার করলো। এরপর দু’বার নিড়ানি দিতে হয়েছে আগাছা পরিষ্কার করার জন্য। ভাগ্যিস মাটিটা যথেষ্ট ভিজে ছিল বিধায় আর নতুন করে সেচের ব্যবস্থা করতে হয়নি। এরপর বীজ বুনলেন, বীজ গজালো। পরম যত্নে জমির পরিচর্যা করলেন।
সার কতটুকু দিতে হবে সে হিসাবটা রহিম মিয়ার থেকে তিনিই ভালো বলতে পারেন। কতটুকু গোবর সার দিলেন সেই থেকে শুরু করে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, সবগুলোর হিসেব তার জানা। সময় নিয়ে আগাছানাশক স্প্রে করলেন। পোকামাকড়ের আক্রমণ হলো কি না সেদিকেও খেয়াল রাখলেন। এরপর এলো পাট কাঁটার পালা। প্রায় চার মাস পর, যখন দেখলেন মাঠের অর্ধেক ফসলে ফুলের কুঁড়ি ধরেছে, তখন বুঝলেন পাট কাঁটার সময় হয়েছে। তড়িঘড়ি করে লোকজন নিয়ে কেঁটে ফেললেন পাট। পাট কাঁটার পর আলাদা করলেন কোনগুলো ছোট ও চিকন এবং কোনগুলো বড় ও মোটা। আলাদা করা হয়ে গেলে আঁটি বেঁদে পাতা ঝরানোর জন্য পাতার অংশ খড়কুটো দিয়ে ৩ দিন ঢেকে রাখলেন যাতে পাতা ঝড়ে যায়। তারপর আঁটিগুলোর গোড়া ৩-৪ দিনের মতো পানিতে ডুবিয়ে রাখলেন জাগ দেয়ার জন্য। এরপরই যেন শুরু হলো মহাযজ্ঞ।
এরপর জাগ তৈরী, জাগ দেয়ার বিশাল এবং পরিশ্রমের পর্ব শেষ করলেন। যখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুঝতে পারলেন যে, পাট যথেষ্ট পঁচানো হয়েছে তখন শুরু করেন আঁশ ছাড়ানো এবং পরিষ্কারপর্ব। দুই পদ্ধতিতে আঁশ পৃথক করা হলেও জমিলা বিবি একটি একটি করে পৃথক করে আঁশ ছড়ান যাতে পাটের গুণগত মান ভালো থাকে। এত পরিশ্রম করার পরও ৩৫০-৪০০ টাকা মজুরিতে যেখানে শ্রমিক রেখে কাজ করাতে হচ্ছে, সেখানে মণে প্রায় ৪০০০ টাকা দাম উঠতেও যেন বাজারের সকলের কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু বীজ কেনা থেকে শুরু করে সেগুলো বপন, চারার পরিচর্যা, কাটা, জাগ দেয়া, আঁশ ছাড়ানো এসবের তো আলাদা খরচ রয়েছেই। তবুও দিনের পর দিন জমিলা বিবি হাসি মুখে টানাটানির সংসার চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই পাটকে অবলম্বন করেই। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য এভাবে তো শেষ হতে দিতে পারেন না!
পুষ্প রাণী, বয়স ২৬। বাড়ির ছোট মেয়ে পুষ্প এখন সংসারের বড় গিন্নি। লেখাপড়ার খুব শখ থাকলেও বাবা মারা যাওয়ায় বিয়ে হয়ে যায়। তবে দুই ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে কোন আপোষ করেননি সে। তাদের নদীর ওপারের বাজারটাতে একটা ছোট দোকান আছে সবজির। এপারের বাজারটাতে সবজির দাম কম আসে বিধায় ওপারের বাজারটাতেই নদী পার হয়ে যান নিজেদের উঠোনের সবজি বিক্রি করতে। লাউয়ের জন্য পুষ্প আলাদা জায়গা করে রেখেছে উঠোনে। লাউ শীতকালীন সবজি হলেও এখন সারাবছর ফলন দিচ্ছে। পুষ্প নিজ হাতে বীজ থেকে চারা করে আশেপাশের বাড়িগুলোতে বিক্রি করেন। উঠোনের যেই কোণাটাতে সবথেকে ভালো আলো-বাতাসের সুবিধা, সেখানে লাউয়ের চারা লাগানোর ব্যবস্থা করেন তিনি। চারা লাগানোর আগের দিন ভালোভাবে মাটি ভিজিয়ে দেন। জমিটা যেন একটু উঁচু হয়, অন্যান্য জায়গা থেকে সেদিকেও খেয়াল করেন। খুব বেশি সার কিনতে পারবেন না বিধায় গোবর সার আর বাড়ির ফলমূলের সবজি দিয়ে নিজেই সার তৈরি করে।
চারাগুলো একটু ধরতে শুরু করলে সে মাচা বানিয়ে দেয় লতাগুলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। এতে করে ফলন ভালো হবে, গুণগত মান অক্ষুণ্ণ থাকবে। এরপর আগাছা ছাটলো, শোষক শাখা ছেটে দিলো, সময়মতো সার দিলো, দ্রুত ফল আসার জন্য ফুলগুলোর পাপড়ি ছাড়িয়ে পরাগায়ন করে দিল। এরপর আস্তে আস্তে ফুল থেকে ফল এলো, এরপর যখন ফল খাওয়ার উপযোগী হলো, তখন বাজারের জন্য লাউগুলো তৈরি করে দিল। লাউ সব ধরনের আমিষের সাথেই যেহেতু যায়, তাই লাউয়ের চাহিদাও ভালো। আর শীতকালে কচি লাউ দুপুরের আসরে যেন সবার চাই। তবু বাজার পর্যন্ত যেতে যেতে পুষ্পের পরিবার পর্যাপ্ত মূল্য পায় না। বাজারে যেখানে ১০০ থেকে ১২০টাকা করে বিক্রি করতে পারে, সেখানে চাষী পর্যায় থেকে কোন পাইকারি বিক্রেতার হাতে গেলে তিনি যেন দামই ছাড়তে চান না। তাই পুষ্পের পরিবার নিজেরাই নৌকায় করে ওপারের বাজারে গিয়ে লাউ বিক্রি করে। তখন আবার যাওয়া-আসার খরচ, সে যেন আরেক মহাযজ্ঞ! তবুও ধৈর্য্যের সাথে পুষ্প এই কাজকে আঁকড়ে রেখেছে। তার মতে, দু’বেলা তার ক্ষেতের লাউ যদি কারো পাতে জোটে তবে তৃপ্তি করে খেতে পারবে আর তাকে মন ভরে আশীর্বাদও করবে।
৮০ ভাগ সরাসরি কৃষিকাজের সাথে জড়িত পেশাজীবী মানুষের দেশে এমন হাজারো জমিলা বা পুষ্প, আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দেশের মোট কৃষিকাজের সাথে সম্পৃক্ত জনশক্তি মাঝে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী। ৮০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে পারিবারিক কৃষির হাত ধরেই। ধান, গম, ভূট্টা, আলু, প্রভৃতি বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল হলেও প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট এদেশে সব ফসলই জন্মে। দেশীয় সবজি বা ফলফলাদির সাথে প্রযুক্তির মিশেল, দিনকে দিন কৃষিকে নিয়ে যাচ্ছে অনন্য চূড়ায়। তবে খুব সংখ্যক প্রান্তিক চাষীই এসবের সুবিধা পাচ্ছে না। বিশেষ করে, এমন হাজারো নারী যারা কৃষি কাজের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।
অথচ দিনশেষে এই নারীদেরই পোহাতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ভোগান্তি। একজন পুরুষ যেখানে কৃষিকাজে দিনমজুর হিসেবে ৪৫০-৪০০ টাকা পাচ্ছেন, সেখানে একজন নারী পাচ্ছেন মাত্র ৩৫০-২০০ টাকা। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বিদ্যমান থাকায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, নারীরা পিছিয়ে আছেন। সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতিতেও তাদের অন্য পেশায় স্থানান্তর করতে হচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায় হতে শুরু করে যদি সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হতে, এদেশের নারীদের পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত সাহায্য এবং কাঁচামাল সরবারহ করা না হয়, তবে দুঃখজনক হলেও মেনে নিতে হবে যে, অচিরেই এই সিংহভাগ কৃষাণী জীবিকার তাগিদে অন্য পেশায় স্থানান্তর করবে।
লেখক: ফামিন জাহান ঐশী
শিক্ষার্থী
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়