মাছ চাষে কোটিপতি সোহরাব
মৎস্য
রাজশাহী পবা উপজেলায়বছরে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকার মাছ উৎপাদন হয়। এখানকার উৎপাদিত পোনা ছড়িয়ে যায় জেলার সবখানে। এখানকা মাছ উৎপাদন ও বিপণন-বিক্রির সঙ্গে জড়িত হওয়ায় কমেছে বেকারত্বে হার। কর্মসংস্থান ও আর্থিক মুনাফার আশায় বাড়ছে মাছ চাষ। ফলে রাজশাহী সারাদেশে কার্পজাতীয় মাছ উৎপাদনে শীর্ষে রযেছে।
পারিলার বাসিন্দা সোহরাব হোসেন (৫৫)। বাবা নূর মোহাম্মদ মারা যাওয়ার পর ছয় ভাইয়ের মধ্যে হাওয়া বদলের ধাক্কা লাগে। প্রকৃতির নিয়মে একে একে আলাদা হয়ে যান তারা। বাবার পঞ্চম পুত্র হওয়ায় বিপাকে পড়েন সোহরাব। ছোটভাই গোলাম মোস্তফাকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন কৃষি কাজ। একসময় দেখলেন নিজেদের পুকুরে মাছের পোনা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন অন্য মানুষ। স্থির করলেন মাছ চাষ শুরু করবেন।
সময়টা ১৯৯৪। নিজস্ব তিন বিঘা পুকুরে ছাড়লেন মাছের পোনা। এক বছরের মধ্যে ১০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ছাড়লেন সেই পোনা। বছর শেষে ৮০ হাজার টাকা খরচে পকেটে উঠল দেড় লাখ টাকা। এখন তিনি প্রায় ২৮০ বিঘা জমিতে চাষ করছেন কার্প জাতীয় মাছ। শূন্য হাতে শুরু করে বর্তমানে বছরে গুনছেন কোটি টাকা। জেলার সেরা মৎস্য চাষি হিসেবে পেয়েছেন পুরস্কার।
প্রায় ২৭ বছর ধরে মাছ চাষ করছেন সোহরাব হোসেন। ছোট বড় মিলিয়ে তার পুকুর ২৫টি। এর আয়তন ২৮০ বিঘার ওপরে। প্রতি বছর এসব পুকুর থেকে আয় হয় ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। পুকুরে উৎপাদিত মাছ বিক্রি করে তিনি এখন কোটিপতি। চাষ করেন রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্রাসকার্প, ব্লাডকার্প, সিলভারসহ কার্প জাতীয় নানা ধরনের মাছ। পুকুরের এসব তাজা মাছ কৌশলে ট্রাকে করে কয়েকবার পানি বদলিয়ে পাঠান রাজধানীর ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজারে।
সফলতার গল্প শোনালেন অভিজ্ঞ মাছ চাষি সোহরাব হোসেন। জানালেন মাছ চাষ ব্যস্থাপনার নানা কৌশল, ঝুঁকি ও সমস্যার কথা। জানান, এই গ্রামের প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষ মাছ চাষ করেন। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রচুর বেকার মানুষের। রাজশাহীর মোট মৎস্য উৎপাদনের বেশিরভাগ এখানের।
দু-দশক আগের তুলনায় এখন মাছ চাষে পরিবর্তন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন মাছ চাষের খরচ বেড়ে গেছে। সার, খৈল, প্রো-বায়োটিকের দাম আকাশছোঁয়া। প্রতিবিঘা জমিতে মাছ চাষে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ পড়ছে। কোনো সময় লাভ হয় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ, আবার লোকসানও হয়। এক হাজার টাকার সারের বস্তা অনেক সময় ১৭০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। মাছের দামের ঠিক নাই। অথচ আগে কম খরচে মাছ চাষ করে বেশি লাভ হতো।
আরও বলেন, মাছের লেজ, পাখনা, পায়ুপথে পচন রোগ হয়। বাজারে ভালো ওষুধ নাই। পোলট্রির ওষুধ ব্যবহার করতে বলে কোম্পানির লোকজন, এতে কাজ হয় না। তাছাড়া আবহাওয়ার পরিবর্তনে মাছ মরে ভেসে উঠে। আমাদের কিছু করার থাকে না। লোকসান হলে সরকারি সহযোগিতা তো দূরের কথা, ঋণ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। তাই অনেকটাই অনিশ্চিত এ ব্যবসা।
তিনি জানিয়েছে, ১০০ বিঘা জমিতে মাছ চাষ করতে দুই কোটি টাকা খরচ হয়। ১০ লাখ টাকা ঋণ নিতে গেলে জমির দলির চায়। নিজের জমিতে তো আর মাছ চাষ করি না, লিজ নেয়া থাকে। মাছ চাষের কৌশল অবলম্বন হিসেবে আবহাওয়ার দিকে খেয়াল রেখে খাবার দেয়া, পানির অক্সিজেনের দিকে লক্ষ্য রেখে মাছ মজুত করা, নিয়মিত প্রো-বায়োটিকের ব্যবহার করা, জাল টেনে মাছের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। সার্বক্ষণিক মৎস্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ও বাড়িতে অক্সিজেন মজুত রাখা উচিত, যাতে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়। সম্ভব হলে পুকুরে অ্যারেটর যন্ত্র লাগনোর পরামর্শ দেন সোহরাব হোসেন।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহীতে উৎপাদিত মাছের মধ্যে কার্প জাতীয় মাছ প্রায় ৮৫ শতাংশ। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিন প্রায় ১৫০ ট্রাক মাছ রপ্তানি হয়ে থাকে। জেলায় ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে মোট ৫০ হাজার পুকুর রয়েছে। এখানে বছরে মাছ উৎপাদন হয় প্রায় ৮৪ হাজার টন। আর স্থানীয়ভাবে মাছের চাহিদা রয়েছে ৫২ হাজার টন। ফলে রাজশাহীতে চাহিদার বিপরীতে ৩২ হাজার টন বেশি মাছ চাষ হয়। এই মাছের বেশিরভাগ পবার।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অলক কুমার সাহা বলেন, পারিলার মাছ চাষি সোহরাব হোসেন একজন পাইওনিয়ার। তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন। পরামর্শ নিতে আসেন।
পবা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক বলেন, আমি এখানে নতুন। এখন মাঠেই আছি। বগুড়া থেকে মাছ চাষে অভিজ্ঞতা নেয়ার জন্য একটা টিম এসেছে। তাদের সঙ্গে আছি। ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দেয়া ও পাশে থাকাই আমাদের কাজ।-শেয়ার বিজ