দেশবিদেশের বড় চাকরি ছেড়ে গ্রামে গড়েছেন এন্টিবায়োটিকমুক্ত মুরগির খামার
পোলট্রি
বুয়েট থেকে কম্পিউটার প্রকৌশলে পড়াশোনা করে বড় বড় মাল্টিমিডিয়া, টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির চাকরি আর ইউরোপের চাকচিক্যের জীবন ছেড়ে, দেশে এসে মুরগির খামার করেছেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বরইতলী গ্রামের প্রকৌশলী ইমরুল হাসান। নিজ গ্রামেই প্রতিষ্ঠা করেছেন ভিন্ন এক মুরগির খামার, যার নাম ‘অর্গানিক চিকেন’। বর্তমানে ইমরুলের ফার্মে প্রায় দেড় হাজারের মুরগি রয়েছে। ক্রেতাদের ঘরে ঘরে এন্টিবায়োটিকমুক্ত মুরগি পৌঁছে দেয়ার জন্য ইমরুলের রয়েছে নিজস্ব ফ্রিজিং ভ্যান।
জানা যায়, ইমরুল ২০০৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়াশোনা শেষ করে যোগ দেন শিক্ষকতায়। অল্প কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পর যুক্ত হন টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে। দেশে তিন বছর কাজ করে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে কিছুদিন কাজ করে আবার মিসর, ফিলিপাইন, আবুধাবি প্রভৃতি দেশে ছয় বছর কাজ করেন; পেয়েছেন যুক্তরাজ্যে নাগরিকত্বও। কিন্তু সেই মোহ ইমরুলকে আটকাতে পারেনি। নাড়ির টানে ফিরে আসেন পৈতৃক বাড়িতে।
কিছুদিন আগেই একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এক অনুষ্ঠানে ইমরুল জানিয়েছেন আভিজাত্য চাকরি আর নাগরিকত্বের হাতছানি ছেড়ে তার দেশে ফিরে আসার কারণ।
ইমরুল বলেন, ‘দু’টি কারণে দেশে ফেরার তাগিদ অনুভব করলাম। আমার বড় ভাই ডাক্তার। তাঁর পক্ষে বাবা-মা’কে দেখাশোনা করা সম্ভব হচ্ছিলো না, তাই বৃদ্ধ বাবা-মার পাশে থাকা প্রয়োজন তাঁদের দেখাশোনার। অন্যদিকে আমার মেয়েটা ক্লাস টু-তে পড়ে। এই সময়ে তাকে ছয়বার স্কুল পাল্টাতে হয়েছে। তাই সেসব চিন্তা করে ২০১৪ সালের অক্টোবরে দেশে ফিরলাম।’
দেশে ফিরে টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে ভালোই চলছিল ইমরুলের দিনকাল। কিন্তু এরমধ্যে সারা পৃথিবীব্যাপি হানা দিল করোনা ভাইরাস। সেসময় ইমরুল ভিন্ন কিছু করার চিন্তা করেন।
যে চিন্তা সেই কাজ— গাজীপুরের কালিয়াকৈরে নিজের গ্রামের বাড়িতেই শুরু করে দিলেন গরু-ছাগলের ফার্ম। কীভাবে ফার্মের গরু-ছাগলদের মান ভাল রাখা যায়, সেটার জন্য রীতিমত রিসার্চ করে বের করলেন সব ফন্দি; নিজেই যেহেতু প্রকৌশলী তাই তাকে এর জন্য বেশি বেগ পোহাতে হয়নি। কিন্তু এরমাঝে করোনায় আক্রান্ত হন তিনি। হাসপাতালে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন কোনোমতে। তারপর আবার পুরোদমে শুরু করলেন ‘অর্গানিক চিকেন’ খামার নামে মুরগির ব্যতিক্রমি এক খামার। তবে তা গৎবাঁধা কোন খামার নয়, আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রকৃতির সমন্বয়ে স্মার্ট ফার্মিং। খামারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ থেকে আলো-বাতাসের পর্যাপ্ততা নির্ণয়, পানি ব্যবস্থাপনা, সবই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে কম্পিউটারের মাধ্যমে। ইমরুলের নিজের হাতে তৈরি এসব প্রযুক্তি।
অর্গানিক চিকেন এমন ফার্ম তৈরির চিন্তার ব্যাপারে ইমরুল হাসান জানান, ‘গতবছর আমি করোনায় আক্রান্ত হলাম। হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো। ভয়াবহ অবস্থা। হাসপাতালে শুয়েই চিন্তা করছিলাম আমাদের ইমিউন সিস্টেম নিয়ে। অর্থাৎ আমাদের খাবার আমাদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা দিচ্ছে না। খাদ্যের ভেজাল আমাদের সর্বনাশ করে দিচ্ছে। তখনই চিন্তা করলাম বেঁচে থাকলে অর্গানিক খাদ্য উৎপাদন করব। আল্লাহর অশেষ রহমতে এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। বেঁচে ফিরে চিন্তা করতে থাকলাম কীভাবে শুরু করা যায়। এবার পড়াশোনা শুরু করলাম অর্গানিক উপায়ে মুরগি উৎপাদনের।
বর্তমানে ইমরুলের ‘অর্গানিক চিকেন’ ফার্মের বয়স বছরখানেক হয়েছে, এর মাঝেই তিনি ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। তবে সচরাচর বাজারে পাওয়া ফার্মের মুরগির চাইতে দরে কিছুটা বেশি শিমুলের অর্গানিক চিকেন খামারের মুগির দাম। দামে কিছুটা বেশি রাখার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমরা অর্গানিক মুরগি কেজি দরে ২৫০ টাকা করে বিক্রি করছি। যদিও বাজারের ফার্মের মুরগি ১৬০-১৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। কিছু টাকা বেশি নিচ্ছি, কারণ আমরা অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত ও প্রাকৃতিকভাবে মুরগি বড় করছি বলে খরচ অন্যদের চেয়ে বেশি।
মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক না দিয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সুস্থ রাখতে চাইলে স্বাস্থ্যকর খাবার দিতে হয়। অর্গানিক গাইডলাইন মেনে স্বাস্থ্যকর খাবার নিশ্চিত করতে খরচটা বেশি হয়। এর সাথে যোগ হয় বিদ্যুৎ খরচ। তবে আমরা চেষ্টা করছি খরচটা আরও কীভাবে কমিয়ে আনা যায়।’
কোনোরকম অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করার ফলে বিভিন্ন ঋতু পরিবর্তনে মুরগি বাঁচিয়ে রাখা অনেক সময় চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও ইমরুল কোনোরকমের কৃত্রিম অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন না। ফলে লোকসানের মুখেও পড়তে হয়েছে। একবার পুরো খামারের প্রায় ৪০ শতাংশ মুরগি মারা পড়ল। সে যাত্রায় লোকসান হলো ৬ লাখ টাকা। আরেকবার মারা গেল ৬০ শতাংশ মুরগি। তবে সেগুলো ছোট হওয়ায় লোকসান কিছুটা কম ছিল। ইমরুল বলেন, ‘এখনো ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মাধ্যমে এগোচ্ছি। লাভ-লোকসানের ঝুঁকির মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হচ্ছে। ব্যবসা এমনি।’
বর্তমানে ইমরুলের ফার্মে প্রায় দেড় হাজারের মুরগি রয়েছে। ক্রেতাদের ঘরে ঘরে এন্টিবায়োটিকমুক্ত মুরগি পৌঁছে দেয়ার জন্য ইমরুলের রয়েছে নিজস্ব ফ্রিজিং ভ্যান। অর্ডার করলেই সেই ভ্যানের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি মুরগি পৌঁছে দেন। ইমরুল স্বপ্ন দেখেন, একদিন শিক্ষিত যুবকেরা চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজেরাই হয়ে উঠবেন উদ্যোক্তা।