আগের নিয়মেই সার পরিবহণ সুফল পাবে কৃষক
কৃষি বিভাগ
কারখানা থেকে সার পরিবহণে নিয়ম বদল করে জারি করা বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ‘বিতর্কিত’ প্রজ্ঞাপনের ওপর ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে কেন এটি বাতিল করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন উচ্চ আদালত। চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। নির্দেশনায় সার পরিবহণ ডিলারদের মাধ্যমে আগের নিয়মে করতে বলা হয়েছে।
এদিকে উচ্চ আদালতের এমন নির্দেশনার পর সারা দেশের সারের ডিলার ও কৃষকদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। তারা বলছেন, ডিলারদের মাধ্যমে পরিবহণ হলে সারের দাম যেমন হাতের নাগালে থাকবে তেমনি সরকার ও কৃষক বিপুল অঙ্কের লোকসান থেকে বাঁচবে। আবাদের ভরা মৌসুমে পরিবহণ নৈরাজ্যের কারণে সারা দেশে সার মিল রেটের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। টাকা দিয়েও কোথাও কোথাও সার মিলছে না বলে অভিযোগ উঠছে।
জানা যায়, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (সিইউএফএল), কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো), ডাই অ্যামুনিয়া ফসপেট (ডিএপি) ও পতেঙ্গায় অবস্থিত ট্রিপল সুপার ফসপেট (টিএসপি) কারখানা থেকে চট্টগ্রাম ছাড়াও সারা দেশে সার সরবরাহ করা হয়। দেশের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত কারখানা থেকেও একইভাবে সার সরবরাহ করা হয়। দেশে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার সারের ডিলার রয়েছে। বিসিআইসির এসব ডিলারের চাহিদা অনুযায়ী সার বরাদ্দ দিত কৃষি মন্ত্রণালয়। ডিলাররা নিজ খরচে কারখানা গেট থেকে নিজ নিজ এলাকায় ট্রাকে করে সার নিয়ে যেত এবং তা সরকার নির্ধারিত দামে কৃষকদের হাতে পৌঁছে দিত।
সূত্র জানায়, প্রায় ১১ বছর আগে ইউরিয়া সার পরিবহণের কাজটি বিসিআইসি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। টেন্ডারের মাধ্যমে সার পরিবহণ কাজ দিয়ে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে। ইউরিয়া সারের মতো চলতি বছরের জুলাই থেকে টিএসপি ও ডিএপি সার পরিবহণের দায়িত্বও বিসিআইসি নিজেরাই নিয়ে নেয়। চলতি বছরের ২৮ মে বিসিআইসি এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। বিসিআইসির পরিচালক (বাণিজ্যিক) আমিন উল আহসান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনের বিষয় ছিল ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জুলাই-২১ থেকে বিসিআইসি কর্তৃক উৎপাদিত টিএসপি ও ডিএপি সার কারখানা হতে পরিবহণ করে বাফার/কারখানা গুদাম হতে সরবরাহের লক্ষ্যে পরিবহণ ঠিকাদার নিয়োগ প্রসঙ্গে।’ এই প্রজ্ঞাপনের পর বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণাধীন চট্টগ্রাম ডিএপি, টিএসপি কমপ্লেক্সহ বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষ সরকারি সংস্থা বিআরটিসির সঙ্গে সার পরিবহণের চুক্তি করে। চুক্তি শেষে কারখানা থেকে সার পরিবহণের জন্য নতুন করে টেন্ডার আহ্বান ও ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করবে কারখানাগুলো। রিট দাখিলকারী সারের একাধিক ডিলার জানান, ইউরিয়া সার থেকে শুরু করে টিএসপি ডিএপিসহ সব ধরনের সার প্রায় ৪০ বছর ধরে নিবন্ধিত ডিলাররা পরিবহণ করতেন। এ ক্ষেত্রে সরকার সারের ওপর বস্তাপ্রতি নির্দিষ্ট অঙ্কের ভর্তুকি দিত। প্রতি বস্তা সারের দাম নির্ধারণ করে দিত। ডিলাররা নিজ নিজ জেলায় নিজ খরচে সার পরিবহণ করে নিয়ে তা কৃষকের কাছে পৌঁছে দিত। কিন্তু সার পরিবহণের দীর্ঘদিনের নিয়ম বদলে একটি সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেওয়ার পর থেকে সার নিয়ে সারা দেশে কেলেঙ্কারি হয়। ট্রানজিটের নামে গায়েব হয়ে যায় হাজার হাজার টন সার। বিসিআইসি ও পরিবহণ ঠিকাদারদের সিন্ডিকেট রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যান। বাফার গুদামে সার মজুত রেখে উৎকোচের বিনিময়ে সরবরাহ করা হয়। বিসিআইসির একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্তে ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২০০ কোটি টাকার প্রায় ৫৮ হাজার টন সার গায়েবের অভিযোগ ওঠে। এর সঙ্গে বিসিআইসির অসাধু কর্মকর্তা ছাড়াও ৬টি পরিবহণ ঠিকাদারকে দায়ী করা হয়। অন্যদিকে সার গায়েব ও পরিবহণ নৈরাজ্যের কারণে সারা দেশের কৃষকদের পাশাপাশি ডিলাররাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকেন।
সরকারও এই খাতে বিপুল লোকসানের মুখে পড়ে।
সূত্র জানায়, মূলত এসব কারণেই ডিলারদের পক্ষে ৩৮ ব্যক্তি উচ্চ আদালতে রিট দাখিল করেন। রিটে শিল্প মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় বিসিআইসিহ সংশ্লিষ্ট ৯টি প্রতিষ্ঠান ও এর দায়িত্বশীলদের বিবাদী করা হয়। এতে টেন্ডারের মাধ্যমে সার পরিবহণ ঠিকাদার নিয়োগ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন বাতিল চাওয়া হয়। আগের নিয়মেই সার পরিবহণে ফিরতে সরকারকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয় উচ্চ আদালতে। ১৫ নভেম্বর বিচারপতি মামনুন রহমান এবং বিচারপতি খন্দকার দিলিরুজ্জামানের দ্বৈত বেঞ্চ বিসিআইসির ওই প্রজ্ঞাপন স্থগিত করে চার সপ্তাহের রুল জারি করে বেশকিছু নির্দেশনা প্রদান করেন। যা সামগ্রিক অর্থে কৃষকদের জন্য সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করছেন তারা।