জাত উন্নয়নের অগ্রপথিক শ্লোগানে যশোরে ২ দিনব্যাপী ব্র্যাক কৃত্রিম প্রজনন এন্টারপ্রাইজের AISP বার্ষিক সম্মেলন ২০২৩ অনুষ্ঠিত
প্রাণিসম্পদ
জাঁকজমকপূর্ণভাবে অত্যন্ত সুন্দর মনোরম পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো ব্র্যাক কৃত্রিম প্রজনন সেবাকর্মীদের বার্ষিক সম্মেলন ২০২৩। ‘জাত উন্নয়নের অগ্রপথিক’- এই স্লোগান কে সামনে নিয়ে গত শনিবার ও রবিবার (২০-২১ এপ্রিল ২০২৪) খুলনা রিজিওনের যশোর জেলা সহ ৭ টি জেলার ১১ টি সেলস্ সেন্টারের প্রায় ৩৫০ জন কৃত্রিম প্রজনন সেবাকর্মীদের নিয়ে যশোর ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে উক্ত সম্মেলন ২০২৩ অনুষ্ঠিত ।
কৃষকের সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্র্যাক ১৯৮৭ সালে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গবাদীপশুর জাত উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেয় । সে সময়ে দেশি জাতের গবাদীপশু কম ছিল, তাই দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কৃত্রিম প্রজনন সেবাকে খামারীদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্র্যাক প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর হতে তরল সিমেন নিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করে। তরল সিমেনের মাধ্যমে কৃত্রিম প্রজনন সেবা প্রদান করার ফলে দেশী গরুর জাত উন্নয়ন প্রক্রিয়া কিছুটা গতি লাভ করলেও এই তরল সিমেনের সংরক্ষণ ও গুণগত মান রক্ষা করা কঠিন ছিল। তাই গুণগত মানের কৃত্রিম প্রজনন সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০০ সালে ব্র্যাক নিজস্ব বুল স্টেশনে হিমায়িত সিমেন উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে ব্র্যাকের ২ টি বুল স্টেশনে ৪ হাজারের অধিক কর্মী দেশের ৬৪ জেলায় নিয়োজিত থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ গাভীকে কৃত্রিম প্রজনন সেবা প্রদান করে যাচ্ছে।
উক্ত অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন খুলনা রিজিওনের আরএসএম মোঃ আবুল হোসেন খান । তিনি আগত সকল অতিথিদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রদান করেন। এরপর বরিশাল রিজিওয়নের আরএসএম মোঃ আশরাফুল ইসলাম এআই কর্মীদের মাঝে সুন্দর সাবলীলভাবে মোটিভেশনাল বক্তব্য রাখেন। এরপর পশ্চিমাঞ্চলের জোনাল ম্যানেজার এম. এ মান্নান AISP দের উদ্দেশ্যে সুন্দর দিকনির্দেশনামূলক আলোচনা করেন।
আগত সকল অতিথিদের মাঝে AISP দের গত ২ বছরের কাজের মূল্যায়ণস্বরুপ সারা বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ে সেরা ৯ জন এআই কর্মীদের সাফল্য নিয়ে একটি ভিডিও চিত্র প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয়।
এরপর বক্তব্য রাখেন আগত সকল অতিথিবৃন্দের মূল আকর্ষণ ব্র্যাক কৃত্রিম প্রজনন এন্টারপ্রাইজ এর এজিএম ডা. মোঃ শওকত আলী, শুরুতেই তিনি সকল এআই কর্মীদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানান।
তিনি অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করা এবং গুণগত মানের সেবা কিভাবে খামারির কাছে সহজে পৌছানো যায় সেই বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্দর তথ্যবহুল যুগোপযোগী আলোচনা করেন। এসময় তিনি বলেন, Brac AI Enterprise বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলার ৪৮০ টি উপজেলার শহর থেকে প্রান্তিক পর্যায়ে খামারিদের ব্র্যাকের উন্নত জাতের গুনগতমান সম্পন্ন সিমেন দিয়ে কৃত্রিম প্রজনন সেবা নিশ্চিত করছে। এর ফলে দেশের দুধ ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্জনে ব্র্যাক সাফল্যের অনন্য দাবিদার। এছাড়া ব্র্যাকের উদ্যোগেই প্রথম দেশে নারী কৃত্রিম প্রজনন কর্মী কাজ শুরু করে। বর্তমানে ৫২ জন নারী ব্র্যাকের কৃত্রিম প্রজনন সেবা খামারিদের দিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে দুগ্ধ শিল্পে নতুন মাত্রার গতি সঞ্চার হয়েছে। তিনি বলেন ভারতের শ্বেত বিপ্লবের কারিগর ভার্গিস কুরিয়ানের ন্যায় ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ কে সহজেই তুলনা করা যায় বাংলাদেশের দুগ্ধ শিল্পের বিকাশে অন্যতম কারিগর হিসেবে। তিনি বাংলাদেশের দুগ্ধ শিল্পের বিকাশের জন্য ১৯৮৭ সালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম কৃত্রিম প্রজনন সেবা চালু করেন যা বর্তমানে ৩৭ বছর পেরিয়ে খামারীদের নিকট সততা ও নিষ্ঠার সাথে উন্নত গুনগতমান সম্পন্ন কৃত্রিম প্রজনন সেবা দিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে বাংলাদেশ এখন অনেকটা দুধ ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে দরকার Smart AISP সে লক্ষ্যে ১১ টি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষ কর্মী তৈরিতে নিরলসভাবে কাজ করছে ব্র্যাক। বর্তমানে ব্র্যাক বাংলাদেশে কৃত্রিম প্রজননে সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান এবং সবচেয়ে বেশি প্রায় ১০ লাখের অধিক খামারিদের প্রজনন সেবা প্রদান করে আসেছে। যার ফলে দেশে প্রতিবছর ২৩ লাখের অধিক উন্নত জাতের বাছুর উৎপাদন করছে ব্র্যাক এবং তৈরি হচ্ছে অধিক উৎদপাদনশীল গাভী ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে দুধ ও মাংসের উৎপাদন। তিনি আরো বলেন, ব্র্যাক কৃত্রিম প্রজনন সেবা অত্যন্ত সফল। ব্র্যাকের কৃত্রিম প্রজনন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীরা প্রকৃতপক্ষে কৃষকদের গাভী প্রজননের জন্য সরাসরি কৃষকের বাড়িতে আসেন এবং ব্র্যাকের সিমেনের গর্ভধারণের হার গড়ে ৭০ শতাংশেরও বেশি।
ডা. শওকত আলী আরো যোগ করেন ব্র্যাক আগামীতে আরো উন্নত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করেছে। ব্র্যাক তার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আধুনিক ২ টি বুল স্টেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় ৪৯৫ টি উপজেলার সকল খামারীকে কৃত্রিম প্রজননের আওতায় নিয়ে আসবে এবং সেই সাথে বাংলাদেশের মোট কৃত্রিম প্রজননের ৮০ ভাগ খামারীকে ব্র্যাকের সিমেন ব্যবহার নিশ্চিত করবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এআই কর্মীদের জন্য ব্র্যাক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহন করেছে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মত কৃত্রিম প্রজনন সেবা কর্মীদের জন্য সাহসী পদক্ষেপ যৌথ সঞ্চয় তহবিল প্রেনশন এর ব্যবস্থা করেছে যাতে কর্মীদের অবসর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ব্র্যাক নিজস্ব বুল এন্ড বাক মাদার হার্ড চালু করেছে। এআই এন্টারপ্রাইজ সম্পূর্ণ ডিজিটাল করা হচ্ছে। কর্মীদের জন্য এপস তৈরির কাজ চলছে। নিজস্ব নাইট্রোজেন সংরক্ষণ সেন্টার করা হয়েছে। ২ টি আধুনিক বুল স্টেশনে বার্ষিক ৯৫ লাখ সিমেন উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করেছে। ব্র্যাক সিমেনের গুনগত মানের জন্য বাংলাদেশে প্রথম ISO সনদ লাভ করেছে। গত তিন বছরে ১ লাখ ২০ হাজার খামারিদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে । গত তিন বছরে ১২৫ জন রোগে আক্রান্ত ও দুর্ঘটনায় আহত এবং ৩২ জন নিহত কর্মীদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করেছে ব্র্যাক। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য কর্মীদের গত ২ বছরের কাজের মূল্যায়ন স্বরুপ কর্মীদের পুরুষ্কৃত করা, খেলাধুলা, মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং আগামী দিনে আরো অধিক উন্নত সেবা প্রদান, খামারী পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন যশোর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোঃ রাশেদুল হক, যশোর সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ ফারুক হোসেন, যশোর জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের উপপরিচালক কৃষিবিদ প্রভাষ চন্দ্র গোস্বামী। এসময় অতিথিরা খুলনা রিজিওনের ২০২১-২২ সালের মোট ৬৪ জন সেরা সেবাকর্মীদের পুরষ্কার প্রদান করেন এবং তারা কর্মীদের জন্য ব্র্যাকের এই ধরণের উদ্যোগকে স্বাগত ও ধন্যবাদ জানান। তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ তথা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে প্রাণিসম্পদ এবং ব্র্যাক যৌথভাবে কাজ করবে। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ব্র্যাককে ধন্যবাদ জানান। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন ব্র্যাক এআই এন্টারপ্রাইজ এর খুলনা রিজিওনের ভিএস ডা. ওলিদ হোসেন।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাক যশোর বিএলসি অপারেশন ম্যানাজার, যশোর বিডিসি, সহ এরিয়া সেলস ম্যানেজারবৃন্দ মোঃ মনোয়ার হোসেন, মোঃ ফরহাদ আখন্দ, বিপ্লব কুমার দাস প্রমুখ । উক্ত অনুষ্ঠানে সারাদিন ব্যাপি কর্মীদের জন্য ছিল ব্যবসায়িক আলোচনা, খেলাধুলা, পুরুষ্কার বিতরণ, রাফেল ড্র। শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সফল বার্ষিক সম্মেলন সমাপ্ত হয়।