পার্বত্য আদিবাসীদের নববর্ষ উদযাপন
পাঁচমিশালি
সুলতান মাহমুদ আরিফ: প্রকৃতি নির্ভর আদিবাসী বলতেই উৎসব প্রিয় এক জনগোষ্ঠীকে বুঝানো হয়। বলা চলে,আদিবাসীরা জন্ম থেকেই বিভিন্ন উৎসবে মেতে থাকে সারা জীবন। এমনকি আদিবাসীরা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পরও মৃত দেহ নিয়ে মেতে উঠে উৎসবে। যার নাম অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। মধ্যকথা আদিবাসীরা সামাজিক কালচার এবং ধর্মীয় মনোভাব এই দু‘টোর সংমিশ্রণে সারাজীবন উৎসবমুখর থাকে।
বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১২টি আদিবাসীদের বসবাস। তাদেরমধ্যে কেউ বৌদ্ধ, হিন্দু, খৃস্টান আবার কেউবা জড়-উপাসক। আর এরা সবাই তাদের নিজ নিজ ধর্ম আর সংস্কৃতির ধারা মোতাবেক তাদের স্ব স্ব উৎসবগুলো পালন করে থাকে।
উপজাতীয় উৎসবগুলো বেশির ভাগ ঋতুর সাথে সম্পর্কিত। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের উৎসবের মহড়া বেজে উঠে। আদিবাসীদের দেহ মনে ঋতু পরিবর্তনে এক আনন্দের বার্তা জেগে উঠে। বিশেষ করে পুরাতন বছরের বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ করে নেয়া যেন তাদের রক্তের সাথে মিশে থাকা এক মহানান্দ। কেবল পার্বত্য আদিবাসী না, পৃথিবীর বহু জাত এবং আদিবাসীরা পুরাতন বছরের বিদায়ের দিনক্ষণ এবং নতুন বছরের শুভ পদার্পনের দিনটিকে বেশ আনন্দময় করে পালন করে থাকে।
বাংলাদেশেও চৈত্র-সংক্রান্তি ও নববর্ষ একটি প্রাচিনতম ঐতিহাসিক ঋতুধর্মী উৎসব। বাংলাদেশে এই নববর্ষ তথা বাংলা নতুন বছরের আগমণে নানা রকম উৎসব হয়ে থাকে। উৎসবগুলোর মাঝে অন্যতম হলো, হালখাতা, গরুর লড়াই, বলি খেলাসহ নানাবিদ আয়োজনের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা এই দিবসকে পালন করে আরো ভিন্ন আঙ্গিকে আর ভিন্ন পরিক্রমায়।
তাদের উলেখযোগ্য কয়েকটা গুরুত্ববহ উৎসব হল:
মারামা আদিবাসীরা পালন করেন‘সাংগ্রাই’, চাকমা এবং তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতির রয়েছে ‘বিজু’, ত্রিপুরা ও উসুই আদিবাসীরা পালন করেন ‘বৈসুক’। এছাড়াও ম্রো ও খুমীরা পালন করেন ‘ক্লুবং প্রাং’ উৎসব।
বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোতেও এসব উৎসব একইভাবে পালন করে সেই সকল উপজাতীয় জনগোষ্ঠীরা। তবে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে অহমীয়া বাঙ্গালি আর পার্বত্য চট্টগ্রামের মাঝে যেন এক মিলবন্ধনের দৃশ্যপট অবলোকন করা যায়।
নিম্নে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে পালিত হওয়া উপরে উল্লেখিত ৪টি উৎসব নিয়ে আলোকপাত করা হল।
১.মারামা আদিবাসীদের সাংগ্রাই’ উৎসব
মারমা আদিবাসীদের নববর্ষকে ঘিরে অন্যতম উৎসব হলো “সাংগ্রাই উৎসব”। পুরাতন বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে বরণে তারা এই উৎসব পালন করে থাকে। এই উৎসব তারা প্রধানত ৪ দিনব্যাপী পালন করে থাকে। পুরাতন বছরের শেষ তিনদিন আর নতুন বছরের প্রথম দিন।
আর এই চার দিনকে মারমা‘রা তাদের ভাষায় নামকরণ করছেন, যথাক্রমে: সাংগ্রাই আকিয়ানিহ, সাংগ্রাই আক্রানিহ, সাংগ্রাই আতানিহ এবং লাছাইংতারা।
পুরাতন বছরের শেষের তিন দিনের প্রথম দিনকে মারমা ভাষায় বলা হয় ‘সাংগ্রাই আকানিয়াহ’। এই দিনে মারমা আদিবাসীদের পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পোষাক পরে মিছিল করতে করতে তাদের বৌদ্ধমূর্তিকে নদীর ঘাটে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে তারা বৌদ্ধ মূর্তিকে চন্দন পানি অথবা দুধ দিয়ে গোসল করায়। তারপর আবার মূর্তিগুলোকে বাড়ি কিংবা মন্দিরে নিয়ে রাখে।
পুরাতন বছরের শেষ ২দিনকে বলা হয় যথাক্রমে-‘সাংগ্রাই আক্রাইনিহ এবং সাংগ্রাই আতানিহ’। এই দু‘দিনে মারমাদের মাঝে যেন নেমে আসে আনন্দের বন্যা। এই দু‘দিন তাদের পাড়ায় পাড়ায় চলে ‘পানি খেলা’ উৎসব আনন্দ। এই দু‘দিনে তারা একেঅপরকে পানি দিয়ে ভিজানোর মাধ্যমে পুরাতন বছরের সকল ব্যর্থতা আর নতুন বছরকে স্বচ্চতার অবয়বে বরণ করে নিতে চাই। এরপর আসে নতুন বছরের প্রথম দিন ‘লাছাইতারা’। এই দিনকেও তারা খুব আনন্দে গ্রহণ করে নেয়। তবে মারমাদের এই দিনে কোন পানি উৎসব হয় না।
সাংগ্রাই উৎসব যেন মারমাদের মনের মাঝে এক অন্যরকম আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। মারমা আদিবাসী মেয়েরা এই ৪দিনের সাংগ্রাই উৎসব শুরুতে আগে বৌদ্ধমন্দিরগুলো পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে নেয়। নিজেদের ঘরবাড়িগুলো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখে। মারমা আদিবাসী সাংগ্রাই উৎসবে যেভাবে আনন্দ আর সাজ গোঁজ করে, বছরের আর কোন দিনে তাদের এমন সাজ দেখা যায় না।
এই সাংগ্রাই উৎসব কেবল পার্বত্য চট্টগ্রাম না, প্রতিবেশি রাষ্ট্র মায়ানমারসহ ভিবিন্নদেশে পালিত হয়।
২.চাকমা আদিবাসীদের ‘বিঝু’ উৎসব
নববর্ষকে বরণ করে নিতে চাকমারা পালন করে ‘বিঝু’ উৎসব। এই বিঝু উৎসব চলে তিনদিন ধরে বিভিন্ন আনন্দের মধ্য দিয়ে। প্রতি বছর এই সময় চাকমা জনপদে বি-ঝু-বি-ঝু এক ধরণের পাখির কলকাকলির মত আওযাজ স্মরণ করিয়ে দেয় নতুন বছরের আগমনী বার্তা। ঘরে ঘরে সাড়া পড়ে যায় আনন্দের সমারোহ। সবাই মাতোয়ারা থাকে তিনদিন ব্যাপি বিঝু উৎসব পালনে।
চাকমারা পর্যায়ক্রমে তিনদিন এই উৎসব পালন করে থাকে। মারমাদের মত চাকমাদেরও এই তিনদিনের রয়েছে নিজস্ব নাম। চাকমাদের এই উৎসবের প্রথম দিনকে বলা হয় ‘ফুল বিঝু’ আর দ্বিতীয় দিনকে বলা হয় ‘মূল বিঝু’ এবং তৃতীয় দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের দিনকে বলা হয় ‘গোজ্যাই পোজ্যা’।
নিম্নে চাকমাদের এই তিনদিন উৎসবের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল-
ফুল বিঝু: চাকমাদের ভাষায় চৈত্রের শেষ দু‘দিনের প্রথম দিনকে বলা হয় ‘ফুল বিঝু’। এই দিনটাকে ফুল বিঝু বলার রহস্য উম্মোচনে কেউ কেউ বলেন, এই দিনে চাকমারা নদীর ঘাটে গিয়া জলদেবী গংগার উদ্দেশ্যে ফুল দিয়ে পূজা করে বিধায় এই দিনকে বলা হয় চাকমাদের ভাষায় ‘ফুল বিঝু’। এই দিনটা চাকমাদের কাছে খুবই পবিত্র একটা দিন। এই দিনে চাকমা যুবক-যুবতীরা নদী থেকে পানি এনে বুড়া-বুড়িদের গোসল করিয়ে তাদের কাছ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে থাকে। পবিত্র মন নিয়ে সবাই বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে রাতে পূজা আর্চনা করে থাকে। রাতে তারা আবার প্রদীপ পূজাও করে থাকে। এছাড়াও আরো বিভিন্ন আনন্দ উৎসবে তারা এই দিনটাকে পালন করে থাকে।
মূল বিঝু: পুরাতন বছরের তথা চৈত্রের শেষ দিনকে চাকমারা বলে ‘মূল বিঝু’। চাকমারা এই দিনে প্রায় পাঁচ পদের তরকারী দিয়ে বানায় পাচন তরকারী উৎসব। এই দিনে চাকমারা বিভিন্ন ধরণের পিঠা তৈরী করে। সকাল থেকেই প্রতিটা ঘরে চলে তাদের ভোজন উৎসব। চাকমাদের এই দিনে কেউ কাউকে নিমন্ত্রণ করে না। সবাই সবার মত করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে খাওয়া উৎসবে যোগদান করে আনন্দ করে। এই দিনে তারা মদ পরিবেশন করে থাকে। মেয়েরা তাদরে কোমরে বোনা রাঙা খাদি জড়িয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। বলা চলে অনেক আনন্দ আর উৎসবের মধ্য দিয়ে তারা এই দিনটা তথা পুরাতন বছরকে বিদায় জানায়। এদিন কেবল আনন্দ করা ছাড়া তারা আর কোন কাজ করে না।
গোজ্যাই পোজ্যা দিন: নতুন বছরের প্রথম তথা পহেলা বৈশাখকে চাকমারা বলে গোজ্যাই পোজ্যা দিন। চাকমাদের ভাষায় গোজ্যা পোজ্যা অর্থ গড়াগড়ি করা। অতীতে এই দিনে চাকমারা প্রচুর মদ পান করতো। এই দিনের ধারণা ছিলো এটি বছরের প্রথম দিন, তাই এই দিনে যদি ভালো খাওয়া হয়, বছরের প্রতিটা দিন ভালো খাওয়া হবে। তাই তারা এই দিনে প্রচুর ভোজনের আয়োজন করে। তারপর বিছানায় গড়াগড়ি করে থাকে। এই দিনে তারা হাসি তামাশায় কাটিয়ে দেই। অনেকে আবার বৌদ্ধমন্দিরে গিয়ে এই দিনে ধর্মকর্মে ব্যস্ত থাকে।
৩.ত্রিপুরা আদিবাসীদের ‘বৈইসুক/বৈইসু’ উৎসব
পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা আদিবাসী সমাজে পুরাতন বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে স্বাগতম জানানোর উৎসবকে বলা হয় ‘বৈইসুক/বৈইসু’। এই উৎসব তারা তিনদিন পর্যন্ত পালন করে থাকে। এই দিনে তারা হাসি আর আনন্দের পাশাপাশি শিবের আশীর্বাদ কামনা করে থাকে। তাদের ধারাবাহিক তিনদিনকে তাদের ভাষায় বলা হয় ‘হারি বৈইসুক, বিসুমা এবং বিসিকাতল’।
হারি বৈসুক: চৈত্র-সংক্রান্তির পূর্বের দিনকে তারা ‘হারি বৈইসুক’ হিসাবে পালন করে। এই দিনে তারা তাদের সকল গবাদি পশুদের গোসল করায়। আবার অনেকে বিভিন্ন রকমের ফুলের মালা দিয়ে তাদের গবাদি পশুদের সাজিয়ে রাখে। খুব ভোরে নদীর ঘাটে গিয়ে তারা দেবতার উদ্দেশ্যে ফুল দিয়ে আসে এই দিনে।
বিসুমা: চৈত্র-সংক্রান্তির দিনকে ত্রিপুরা আদিবাসীরা ‘বিসুমা’ দিবস হিসাবে পালন করে থাকে। এই দিনে খুব প্রত্যুষে তারা তাদের বাড়ি-ঘর এক ধরণের কচুই পানি দিয়ে পরিশুদ্ধ করে থাকে। প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে তারা বিভিন্ন ধরণে পিঠা উৎসব করে থাকে। এই দিনে বিশেষ মুখরোচক খাদ্য হল ‘পচন’ (হাঙ্গর মাছের শুটকিসহ পাঁচ পদের তরকারি দিয়ে এই পচন রান্না করা হয়)। তারা এই দিনে ঘরে ঘরে মদও তৈরী করে থাকে। অতিথিদের এসব পিঠা, পচন আর মদ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এই দিনে তারা সবাই রাগ-অভিমান ভুলে গিয়ে আন্তরিকতার মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
বিসিতকাল: নববর্ষের প্রথম দিনকে ত্রিপুরা আদিবাসীরা ‘বিসিতকাল’ নামে পালন করে থাকে। এ দিনে সকাল থেকে তাদের ঘরে ঘরে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে সবাই। প্রত্যুষে নব দম্পতিরা কিংবা ত্রিপুরা যুবক-যুবতিরা নদীর ঘাট থেকে পানি এনে তাদের গুরুজনদের গোসল করানোর মাধ্যমে আশীর্বাদ নিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়।
উপরোক্ত এই তিন আদিবাসী উৎসব যদিও ভিন্ন ভিন্ন। তথাপি পুরো পার্বত্য জেলায় এই তিনটা উৎসব তথা মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ চাকমাদের ‘বিঝু’ আর ত্রিপুরাদের ‘বৈইসুক‘কে এক সাথে বলা হয় ‘বৈসাবি’। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এখানে ‘বৈ’ এসেছে ত্রিপুরা আদিবাসী ‘বৈইসুক’ থেকে, ‘সা’ এসেছে মারাম আদিবাসী ‘সাংগ্রাই’ থেকে আর ‘বি’ এসেছে চাকমা আদিবাসী ‘বিঝু’ থেকে।
বছরের শেষ দু‘দিন আর নতুন বছরের প্রথম দিনই মূলত তাদের বর্ষবরণ উৎসব ‘বৈসাবি’ পালন করা হয়। আর এই বৈসাবি উৎসবে বান্দরবান, রাঙ্গামাটি এবং খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় নেমে আসে আনন্দের মহড়া। এই তিন আদিবাসী উৎসবকে ঘিরেই মূলত পালিত হয় নববর্ষ উদযাপনের চিত্র।
এছাড়াও নতুন বছরকে বরণ আর পুরাতন বছরকে বিদায়ে আরো একটি আদিবাসী উৎসবমুখর আয়োজন করে থাকে। তারা হলেন ‘ম্রো ও খুমী’ আদিবাসীরা। তারা এই দিনে ‘ক্লুবং প্লাই’ নামক উৎসব পালন করে। চৈত্র মাসের শেষ দিন তারা ফুল-পূজা করে। বনের নানা রঙের ফুল এনে তারা তাদের বাড়ি ঘরসহ নিজেরাও সাজে। ১লা বৈশাখে তারা বুড়ো-বুড়ীদের স্নান করায়। তারপর তারা পচন রান্না করে। এই দিনে তারা নৃত্যগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। যুবতীরা এই দিনে দাঁতে প্রাকৃতিক রঙ লাগিয়ে নৃত্যগীত অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। আর যুবকরা তাদের ‘প্লু’ তথা বাঁশী বাজিয়ে আনন্দে মেতে উঠে।
সুলতান মাহমুদ আরিফ
শিক্ষার্থী এবং গণমাধ্যমকর্মী।
[email protected]